হোমঅন্যান্যঅন্তর্তদন্ত : পর্ব ৫- গোয়েঙ্কারা সিইএসসি-র মালিক হলো কি করে ?

অন্তর্তদন্ত : পর্ব ৫- গোয়েঙ্কারা সিইএসসি-র মালিক হলো কি করে ?

অন্তর্তদন্ত : পর্ব ৫- গোয়েঙ্কারা সিইএসসি-র মালিক হলো কি করে ?

শ্যামল সান্যাল : সিইএসসি-র মত ঐতিহ্যবাহী সংস্থা গোয়েঙ্কারা কি করে দখল করলেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজে মিলবে না । রাজস্থানের বহু ব্যবসায়ীর মত গোয়েঙ্কারাও কলকাতায় এসেছিলেন। যত দূর জানা যায় , বড় বাজারে খুব ছোটখাটো একটা দোকানে ব্যবসা শুরু করেছিল। সঙ্গে নাকি ছিল দালালির কাজ । এখনকার আর পি জি গ্রুপের মালিকের ঠাকুরদা সেই সদ্য স্বাধীন দেশের কংগ্রেস দলের অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল ভালোই।

সেই সময়ে কলকাতায় বাণিজ্যের জন্য সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষরা আসতে শুরু করেছিলেন কপাল ফেরাতে। সুয়েজ খালের সঙ্গে ভারতের নদী যোগ হয়েছে সবে। কলকাতার বন্দর তৈরি ছিল। আমদানি রপ্তানির মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা বন্দর। ওদিকে ট্রেন চলাও শুরু হয়েছে। 1850 সালে কলকাতা-রানিগঞ্জ রেল লাইনের শুরু। এই রাজ্য ও বিহারে কয়লা খনি থেকে কালো সোনা তোলা শুরু হয়ে যায় এই সময়ে।

ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক , কলকাতার গুরুত্ব কেন ছিল উনিশ শতকের গোড়ায়। কারণ গোয়েঙ্কারা দূরদর্শী ছিল বলে সেই সময়ে এই শহরে ঘাঁটি গেড়েছিল। বাঙালিরা তখন আরামে ঘুমিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সালের দিকে চোখ রাখা যাক।

রেল চলা শুরুর পরের বছর 1851 তে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হল এই কলকাতায়। ৩ বছর বাদে রিষড়ায় 1854 সালে প্রথম জুট মিলে কাজ শুরু হয়। মাটির নিচে দিয়ে নর্দমা হল 1859 সালে। এর 10 বছরের মাথায় মিশরের সুয়েজ খালের সঙ্গে কলকাতার গঙ্গা যুক্ত হবার পরের বছর কলকাতা বন্দরের জন্ম। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা সারা দেশের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে গেল,স্বভাবিক কারণেই । টেলিফোন চালুর সাল হল 1881,সেদিন এই শহরে ট্রাম চলত, ঘোড়ায় টানতো সে ট্রাম।

সেই কলকাতায় বিদ্যুৎ কিন্তু ছিল না। 1895 সালে কলকাতা লাইটিং আইন তৈরি হয়। 1897 সালের 7 জানুয়ারি কিলবার্ন কোম্পানি বিদ্যুতের ব্যবসার লাইসেন্স পেল। ওরা ছিল ব্রিটিশ কোম্পানি কর্মটন- এর এজেন্ট। জন্ম নিল দি ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেড। 1897-এর 14 জানুয়ারি লন্ডনে এই কোম্পানি রেজিস্ট্রি হয়। মূলধন ছিল মাত্র 1 হাজার পাউন্ড।

ফেব্রুরারি মাসে লন্ডনে এই কোম্পানির প্রথম মিটিংয়ে সংস্থার নাম হল ,দি কালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেড, মূলধন বাড়িয়ে করা হল 1 লক্ষ পাউন্ড। কিলবার্ন কোম্পানিকে ম্যানেজিং এজেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়।1899- এর 17এপ্রিলে শহরের প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু হয়েছিল, প্রিন্সেপ স্ট্রিটের কাছে এমামবাগ লেনে।

দীর্ঘ এই ইতিহাসের ভেতরে ঢুকলে সুতনুটির এই গপ্পো ফুরোবে না। যেহেতু ভিক্টোরিয়া হাউসেই সিইএসসি-র সদর দপ্তরে গোয়েঙ্কারা বিদ্যুতের বাণিজ্য শুরু করেন, তাই শুধুমাত্র বলে দেওয়া যাক 1920 সালে এই ভবনের জন্ম। ব্রিটিশ কোম্পানির হেড অফিস লন্ডনের হলবর্নে ,তার নামও ভিক্টোরিয়া হাউস ছিল।

1970 সালের 5 জানুয়ারি এই ব্রিটিশ সংস্থাটি ভারতীয় হলো। প্রথম বাঙালি ও ভারতীয় চেয়ারম্যান ভাস্কর মিত্র 1978-79 সালের বার্ষিক রিপোর্টে বলেন,এই কোম্পানি এখন থেকে হলো কালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশন ( ইন্ডিয়া) লিমিটেড।
গোয়েঙ্কারা সে সময়ে ডানকান হাউসের দখল নিয়েছেন। রমাপ্রসাদ ও তাঁর ভাই গৌরীপ্রসাদ গোয়েঙ্কা ওখানে বসে চা ও অন্য ব্যবসা করতেন।

1977 সালে ভোটে জিতে জ্যোতি বসু হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন গোয়েঙ্কারা বাম দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন। রমাবাবুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও জ্যোতি বসুর গভীর সম্পর্ক ছিল। ইন্দিরা ও বসুর দলের বহু রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু লন্ডনে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন তাঁরা। সেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিন্তু বরাবরই এক ছিল।
রমাপ্রসাদবাবু প্রায়ই মহাকরণে আসতেন , জ্যোতি বাবুর সঙ্গে দেখা করতে। ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি , চপ্পল এই ছিল তাঁর পোশাক।অতি বিনয়ী হাসি তাঁর মুখে থাকত। সংবাদিকদের নমস্কার করে একটি দুটি শব্দ বলে চলে যেতেন।

সিদ্ধর্থবাবুর সময়ের চরম বিদ্যুৎ সমস্যা নতুন বাম সরকারে ঘাড়ে চেপেছিল। জ্যোতিবাবুই বিদ্যুৎ দপ্তরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা চলত লোডশেডিং। অন্ধকার হলেই বিভিন্ন এলাকায় মানুষজন শব্দ তুলতেন, ওই জ্যোতি গেল, এই জ্যোতি এলো..।
গোয়েঙ্কারা এই সময়েই কি করে সিইএসসি-র মালিকানা পেলেন তা এক দুরন্ত কাহিনী। ( ক্রমশ)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img