হোমশাশ্বত_বাণীপঞ্চদীপের শিখায় স্বামী বিবেকানন্দ

পঞ্চদীপের শিখায় স্বামী বিবেকানন্দ

পঞ্চদীপের শিখায় স্বামী বিবেকানন্দ

  • (১) স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজের দৃষ্টিতে – (শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ) : একদিন দ্বিপ্রহরে মঠে রয়েছি, স্বামীজী আহারের পর আমাকে ডেকে বললেন, “দেখ বাঙাল! (স্বামীজী আমাকে ‘বাঙাল’ বলে ডাকতেন) আজ তুই আমাকে একটু massage করে দে তো।” স্বামীজীর কাছ থেকে তৎপূর্বে আমার দীক্ষা হয়েছে, গুরুসেবা করার সুযোগ পেলাম বলে আনন্দে তাকে massage করতে লাগলাম। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই স্বামীজী বললেন, “না, এ তোর কাজ না, তুই রাজা (ব্রহ্মানন্দজী মহারাজ) কে ডেকে দে।” তখন মহারাজ আহার করে শুয়ে পড়েছেন। ধীরে ধীরে তাঁর ঘরের কাছে গিয়ে তাঁর দরজায় টোকা মারলাম। মহারাজ জেগে ছিলেন, “কে?” বলে দরজা খুলে দিলেন এবং আমার টোকা দেবার কারণ কি জিজ্ঞাসা করলেন। স্বামীজী massage করবার জন্য তাঁকে ডাকছেন, সসঙ্কোচে তা বললাম। মহারাজ কিন্তু তৎক্ষণাৎ ফতুয়াটি গায়ে দিয়ে কাপড় মালকোঁচা করে পরে স্বামীজীর ঘরে প্রবেশ করলেন। স্বামীজী বললেন, “দেখ রাজা, আজ শরীরটা খারাপ বোধ করছি। তাই এই বাঙালটাকে massage করতে বলেছিলাম, কিন্তু ও কিছুই করতে পারল না, তাই তোকে ডেকেছি।” মহারাজ আর দ্বিরুক্তি না ক’রে তখনই স্বামীজীকে ডলাই-মলাই করতে লাগলেন এবং পুরো দু-ঘন্টা ঐরূপ করে ঘর্মাক্ত শরীরে বাইরে এলেন এবং তাঁর নিজের ঘরে গেলেন। আমি ঘরের বাইরে ছিলাম। কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে পুনরায় ধীরে ধীরে তাঁর দরজায় টোকা দিলাম। মহারাজ আমাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুনরায় ঘা দেবার কারণ কি, জিজ্ঞাসা করলেন। তখন অতিশয় সঙ্কোচের সঙ্গে তাঁকে বললাম, “মহারাজ আজ আমার মনে বড় একটা সংশয় উঠেছে, তা দূর করার জন্য আপনার কাছে আবার এই সময় এসে বিরক্ত করছি।” মহারাজ অভয় দিয়ে বললেন, “কি বল্ !” তদুত্তরে বললাম, “মহারাজ, শুনেছি—আপনি শ্রীশ্রীঠাকুরের মানসপুত্র, স্বামীজীর গুরুভাই, স্বামীজীও আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন অনেক সময় দেখেছি। কিন্তু আজ আপনাকে ডেকে এইরূপ massage করালেন কেন বুঝতে পারছি না।” শুনেই শ্রীশ্রীমহারাজ জিব কেটে বললেন, “বলিস কি রে! সাক্ষাৎ শিব! তুই কি জানিস নে?”
  • (২) স্বামী তুরিয়ানন্দ‌‍‍‌‌: লাটু মহারাজ যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তেন বলে ঠাকুর একবারখুব রেগে যান। তাঁকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন। শেষে স্বামীজী ধরে পড়ে সব গোল কাটিয়ে দিলেন। লাটু মহারাজ তাই বলতেন, “যদি গুরুভাই হয় তবে বিবেকানন্দ”। সারদা (স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ) মঠ ছেড়ে বাড়ি যেতে চাইলে, মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) তাকে বোঝাচ্ছেন, “কেন যাবি? নরেনকে ছেড়ে কোথায় যাবি? এত ভালবাসা আর কোথায় পেয়েছিস? আমিও তো ইচ্ছা করলে বাড়ি গিয়ে থাকতে পারি। আমি তবে কেন পড়ে রয়েছি? ঐ এক নরেনের ভালবাসার জন্য।” আমি একবার স্বামীজীকে ঠাকুরের সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে আমায় বললেন, “ঠাকুরের কথা আর কি বলি? তিনি LOVE personified।”
  • (৩) স্বামী সারদানন্দ: স্বামীজী কাউকে তাচ্ছিল্য করতেন না। আমরা যাদের সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা বোধ করতাম, তিনি দু-ঘণ্টা বসে তাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। আমরা সবাই ঠাকুরের ঘরে বসে আছি, স্বামীজী ঘরে ঢুকতেই তাঁর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ঠাকুর চেঁচিয়ে বললেন, “হাঁ, এঁর মতো কেউ নেই। দ্যাখ্। তোকে এখন কেউ বুঝতে পারবে না। তুই ঠিক থাক।” দেহত্যাগের কিছুদিন আগে স্বামীজী একদিন আমাকে বলেছিলেন, “ওরে আর সে মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি না। বেটি আমার হাত ছেড়ে দিলে।” আমি তখন তাঁকে বলি, “সেকি ভাই, তা কখনো হতে পারে? মা তোমার হাত সর্বদাই ধরে আছেন।” সেইদিন থেকে আমি বুঝলাম, স্বামীজীর শরীর দিয়ে মার যা করবার ছিল তা সাঙ্গ হয়েছে।
  • (৪) স্বামী অখণ্ডানন্দ: বেলুড়ে একদিন তখনো রাত আছে, উঠে পড়েছি। উঠেই স্বামীজীকে দেখতে ইচ্ছা হলো। স্বামীজীর ঘরের দরজায় গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি, ভেবেছি স্বামীজী ঘুমুচ্ছেন। উত্তর না আসলে আর জাগাব না। স্বামীজী কিন্তু জেগে আছেন … ঐটুকু টোকাতেই উত্তর আসছে গানের সুরে…
  • “Knocking knocking who is there?
  • Waiting waiting, oh brother dear!
  • Once for all-oh, brother receive me!
  • Once for all-oh, sinner believe me!
  • Unto me Cross thy burden fall;
  • Once for all-oh, once for all!”

স্বামীজীর কথা কি বলব? তাঁর কাছে আমি এতটুকু। মঠে এমন দিনও গেছে যে আলোচনা করতে করতে রাত দুটো বেজে গেছে স্বামীজী বিছানায় শোননি, চেয়ারে বসেই বাকি রাতটা কাটিয়েছেন।

  • (৫) স্বামী অভেদানন্দ: স্বামীজী আমাদের নাম দিয়েছিলেন। আমার নাম দিলেন অভেদানন্দ। গুরুর পাদুকা সামনে রেখে হোম হয়েছিল। আমরা তখন ছোট। তিনি (বিবেকানন্দ) আমাদের মধ্যে বড় ছিলেন। আমরা তাঁকে বড় ভাইয়ের মতো জানতাম, তাঁকেই আমাদের নেতা বলে মানতাম। গুরুভাইদের প্রতি স্বামীজীর কী ভালবাসা এবং বিশ্বাসই না ছিল। তিনিই তো ঠাকুরের অবর্তমানে তাঁর ভালবাসা ও বিশ্বাস দিয়ে গুরুভাইদের সকলকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিলেন। তিনি কি তিনিই জানেন। বিবেকানন্দ, কি আমি বা আমরা যা-কিছু করেছি বা করছি সেসব তাঁরই শক্তি। অশরীরী হয়ে তাঁরই ভাব আমাদের মধ্যে খেলছে।

(সংগৃহীত )

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img