হোমভ্রমণপলাশ পার্বণ

পলাশ পার্বণ

পলাশ পার্বণ

প্রদীপ হাজরা

কথা দিয়েছিলাম আমার প্রথম ভালোবাসাকে…. প্রতি বসন্তে অন্তত একবার করে সাক্ষাৎ করবো তার সাথে…. আমার প্রিয়তমার সাথে..জঙ্গলমহল-এর প্রকৃতির সাথে । এবারও তার অন্যথা হলোনা ; 18 জনের দলবল নিয়ে বৃষ্টিভেজা বাসন্তিক ভোরে রওনা দিলাম আমার ভালোবাসার টানে । জানি সেও আমাদের প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত শিমুল-পলাশ-কুসুমের ডালি সাজিয়ে ! এ সময়টা বড়োই পাগলামিতে পেয়ে বসে আমাকে ! বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, রাঢ় বাংলার আরও অনেক জায়গার সাথে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা , বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা এসময়ে সেজে ওঠে সবুজ শাড়িতে লাল-কমলা-আগুনে রঙের আঁচলে । সমস্ত জঙ্গল পুরোনো পাতার গ্লানি ঝরিয়ে সেজে ওঠে সবুজে…সবুজের কতো রকমের যে শেড হয়, তা একমাত্র এ সময়ে জঙ্গলে গেলেই জানা যায় । লালচে সবুজ, কালচে সবুজ, গালচে সবুজ, হলদেটে সবুজ, মেরুন-সবুজ….সবুজ , সবুজ আর সবুজের জয়গান এসময়ে সর্বত্র !

আর রয়েছে চারিদিকে পলাশের আগুন লাগানো রং, শিমুলের টকটকে লাল ! কুসুমের গাছভর্তি নবপল্লব কোথাও রক্তাভ লাল, কোথাও গোলাপি লাল, কোথাও কমলাটে লালের বাহারে… আহা রে বলে আপনিও তার অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারবেন না ।

সকাল 6-25 টায় শালিমার থেকে রাজ্যরানী এক্সপ্রেস-এ সওয়ার হয়ে বাঁকুড়ায় নামলাম 10-35 টায় ! আমাদের প্রথম গন্তব্য ডোকরা গ্রাম বিকনা | ফেসবুক বন্ধু Shounak Banerjee এর লেখা পড়ে এতটাই ভালো লেগেছিলো যে বারংবার চেষ্টা চালিয়েছি একবার অন্তত বিকনায় যেতে ! এতদিনে সেই সুযোগ হোলো | একটি উইংগার আর একটি মারুতি ভ্যানে চেপে সকলে চললাম বিকনায় । নামমাত্র মূল্যে কি সব অনন্যসুন্দর হস্তশিল্প এখানে বিকোচ্ছে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসই হবেনা | কলকাতার হস্তশিল্প মেলায় এইসব সামগ্রীই বিক্রি হয় দ্বিগুন মূল্যে । শিল্পীরা আপনার চোখের সামনেই কেমন করে গড়ে তুলছেন ডোকরার অসাধারণ নানান মূর্তি, ঘর সাজানোর সামগ্রী…যা দেখে মোহিত হবেনই , একথা জোর গলায় বলতে পারি ।

বিকনায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে রওনা দিলাম আমাদের চারদিনের আবাসস্থল খাতড়া ভারত সেবাশ্রম এর উদ্দেশ্যে | ভারত সেবাশ্রম-এর কর্মকান্ড-এর বিশালতা উপলব্ধি করতে হলে এঁদের রুরাল শাখাগুলোতে আসতেই হবে | এখানের মহারাজ প্রকৃতই মাটির মানুষ | প্রায় একার হাতে সামলে চলেছেন এখানকার সমস্ত কর্মসূচী | বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘের খাতড়া শাখা । খাতরা বাজার থেকে ডানদিকে গিয়ে জনবসতি যেখানে শেষ, সেখানেই দুপাশে ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরির জঙ্গলের শুরু, ছোটো একটা টিলার পাশেই এই আশ্রম ।

কি নেই এখানে ? নেতাজি সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির স্টাডি সেন্টার, প্রাথমিক বিদ্যালয়, উৎকর্ষ বাংলার শাখা, স্কিল ইন্ডিয়ার শাখা, বুক ব্যাঙ্ক, লাইব্রেরি, অবৈতনিক চিকিৎসা কেন্দ্র, কম্পিউটার শিক্ষাকেন্দ্র, মাল্টি জিম, উপাসনা গৃহ এবং নানান ধরণের চ্যারিটেবল পরিষেবা । আর রয়েছে সুন্দর সাজানো গোছানো বাগান ও ছোটদের জন্য পার্ক ।

দুপুরে এখানেই ভোগ খেয়ে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিলাম প্রত্যেকেই | আজ কোথাও বেরোনোর প্রোগ্রাম রাখিনি ইচ্ছে করেই ! পুরো কমপ্লেক্স ভালো করে ঘুরে দেখতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে ! বিকালে আমাদের কচিকাঁচাগুলো দখল নিলো চিলড্রেন পার্কের ! ওদের আনন্দে উদ্ভাসিত মুখগুলোই তো আমাদের পরম শান্তির বিষয় ! রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটি হোটেলে, সকালে নিরামিষ খাবারের পরে যেহেতু প্রত্যেকেই আমিষ খাবারের দিকেই ভোট দিলো সেইহেতু । একটা টোটো রিজার্ভ করে পাড়ি দিলাম পছন্দের সুখাদ্য গ্রহণে । রাতে প্রায় পূর্ণ চন্দ্রের রূপোলী আলো গলে গলে পড়ছিলো আমাদের গা বেয়ে, গাছগাছালির মাথা ধুইয়ে দিয়ে….. রাতচরা পাখিদের ডাকাডাকি শুনতে শুনতে সারাদিনের ক্লান্তির পরে পা বাড়ালাম স্বপ্নের দেশে !

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img