সঞ্জয় বসাক, জগন্নাথ ভক্ত
পুরীর রথ : সংস্কৃত ভাষায় রথ মানে গাড়ি এবং যাত্রা মানে মিছিল। ক্ষণিকের জন্য জগন্নাথদেবকে রথের উপর দর্শন করাকে বহু পুণ্য কর্মের ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি এতই পবিত্র যে, কেউ যদি এই দিনে রথ স্পর্শ করে অথবা এমনকি রথের দড়ি স্পর্শ করে, তাহলে বহু পুণ্য কর্মের ফল লাভ করতে পারেন।
জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় আজও আমরা দেখে থাকি, প্রতিবছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরাক্রমে পুরীর রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী যিনি রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন, তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পরপর তিনটি রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে, বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। তারপর সুভদ্রা পরে জগন্নাথ ।
প্রভু জগন্নাথদেবের রথের নাম ((নন্দী ঘোষ)। এই রথটি দেবরাজ ইন্দ্র শ্রীজগন্নাথদেবকে প্রদান করেন।
রথের উচ্চতা ৩৩ হাত ১ আঙ্গুল।
এই রথ ৮৩২টি কাঠদ্বারা তৈরি।
এই রথের ১৬টি চাকা।
চাকার উচ্চতা ৭ ফুট, চওড়া ৭ ইঞ্চি
রথের রক্ষক হচ্ছেন গরুড়।
রথের ধ্বজায় হুনুমান বিরাজিত।
রথের রঙ লাল ও পিক্ত।
রথে ৯ জন দেবতা অধিষ্ঠিত।
রথের ৪ টি অর্শ/গোড়া,তাদের নাম
বরাহ, শঙ্খ, সেতু ও হরিদাস।
রথের সারথির নাম দ্বারুজ।
রথের দ্বারপাল জয়, বিজয়।
রথের রজ্জুর নাম শঙ্খচূড়।
রথের নেত্রের নাম তৈলক্ষ মোহিনী।
রথের অধীশ্বর প্রভু জগন্নাথ।
জগন্নাথ দেবের রথের প্রতিটি অংশই অতি পবিত্র, কারণ তিনটি রথেই বিরাজ করেন তেত্রিশ কোটি দেবতা। তাই এই রথের রশি একটু স্পর্শ করা বা টানা মানে এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ স্পর্শ করা | যাই হোক, রথ তিনটির চাকার ব্যাস সাত ফুট। প্রতি রথেই ৩৪টি অংশ — চাকা, আরা, ডাণ্ডিয়া, বেকি, হংসপট, কানি, শঙ্খদ্বার, জালি, গইপট, সিংহাসন, রুশিপট ইত্যাদি। রথের চূড়ায় কলস ও সুদর্শন চক্র এবং সবার উপরে ধ্বজা | কয়েক টন ওজনের এই রথ তিনটি টানতে যে খুব শক্তপোক্ত রশি বা দৌড়ি (ওড়িয়া ভাষায়) লাগে তাতে সন্দেহ নেই | তবে এই রশি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কেরল থেকে আসত | আর এখন উড়িষ্যা কয়ার বোর্ড এই দড়ি তৈরি করে দেয় |
বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ ।
সুভদ্রার রথের নাম দেবদলন।
জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ।
পুরীর এই রথ তিনটির আলাদা আলাদা নাম | জগন্নাথ দেবের রথ — নন্দী ঘোষ, বলরামের রথ — তালধ্বজ ও সুভদ্রার রথ — দেবদলন নামে পরিচিত | প্রতি বছর উল্টোরথের পর রথ তিনটি ভেঙে ফেললেও রথের পার্শ্বদেবদেবীর মূর্তি, সারথি ও ঘোড়াগুলিকে সযত্নে তুলে রাখা হয় | এবারে রথ তিনটির একটু পরিচয় দেওয়া যাক :
নন্দীঘোষ (জগন্নাথ) :
উচ্চতা ১৩.৫ মিটার।
কাঠের টুকরো ৮৩২ টি।
ধ্বজার/পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী।
রথের কাপড়ের রং লাল হলুদ।
চাকা-১৮ টি।
নন্দী ঘোষ : এই রথ নির্মাণে ছোট বড় ৮৩২টি কাষ্ঠখণ্ড লাগে। উচ্চতা ৪৪’২” বা ১৩.৫ মিটার ও দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৩৪’৬” x ৩৪’৬”| পূর্বে অষ্টাদশ সিদ্ধির পরিচয়জ্ঞাপক ১৮টি চাকা থাকলেও, বর্তমানে ১৬টি থাকে | রথের ধ্বজার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী ও রশির নাম শঙ্খচূড় নাগিনী। দ্বারপাল ব্রহ্মা ও ইন্দ্র | রথে উপস্থিত নয় জন পার্শ্ব দেবগণ হলেন — বরাহ, গোবর্ধন, কৃষ্ণ/গোপীকৃষ্ণ, নৃসিংহ, রাম, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, হনুমান ও রুদ্র | এঁদের সঙ্গে রয়েছেন ধ্যানমগ্ন ঋষিরা — নারদ, দেবল, ব্যাসদেব, শুক, পরাশর, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও মরীচি। লাল ও হলুদ কাপড়ে মোড়া এই রথে কালো রঙের চারটি ঘোড়া হল , সংখ, বলাহক, শ্বেত ও হরিদাক্ষ | রথের সারথি মাতলি ও রক্ষক গরুড় | রথের কলসের নাম হিরন্ময়।
তালধ্বজ (বলভদ্র/বলরাম) :
উচ্চতা ১৩.২ মিটার।
কাঠের টুকরো ৭৬৩ টি।
ধ্বজার/পতাকার নাম উন্মনী।
রথের কাপড়ের রং লাল-সবুজ।
চাকা-১৬ টি।
তালধ্বজ : ৭৬৩টি ছোট বড় কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে নির্মিত এই রথের উচ্চতা ১৩.২ মিটার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ৩৩’ x ৩৩”। চাকার সংখ্যা ১৪টি | ধ্বজার নাম উন্মনী এবং রশির নাম বাসুকী নাগ | ন’জন পার্শ্বদেবতা হলেন — গণেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গলা, প্রলম্ব, হলায়ুধ, মৃত্যুঞ্জয়, নাটেশ্বর, মহেশ্বর ও শেষদেব | দ্বারপাল রুদ্র ও সাত্যকি | সারথি মাতলি এবং রক্ষক বাসুদেব। রথের শ্বেতবর্ণের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোর, শ্রম (স্বর্ণনাভ) ও দীর্ঘ (দীর্ঘশর্মা)। সুদর্শন চক্রের পাশে দুটি পাখির (কাকাতুয়া) নাম স্বধা ও বিশ্বাস। রথটি সবুজ ও লাল কাপড়ে মোড়া |
দেবদলন (সুভদ্রা) :
উচ্চতা ১২.৯ মিটার।
কাঠের টুকরো ৫৯৩টি।
ধ্বজার/পতাকার নাম নাদম্বিক।
রথের কাপড়ের রং লাল-কালো।
চাকা-১৪ টি।
দেবদলন : ৫৯৩টি টুকরো কাঠ দিয়ে তৈরি এই রথের উচ্চতা ৪২’৩” বা ১২.৯ মিটার এবং দৈর্ঘ্য – প্রস্থ ৩১’৬” x ৩১’৬”| চাকার সংখ্যা ১২। ধ্বজার নাম নাদম্বিক এবং রশির নাম স্বর্ণচূড় নাগ। ধ্বজার পাশের পাখি দুটির নাম শ্রুতি ও স্মৃতি | রথটি লাল ও কালো কাপড়ে ঢাকা | ন’জন পার্শ্বদেবী হলেন — চন্ডী, চামুণ্ডা, মঙ্গলা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শুলিদুর্গা, শ্যামাকালী, বিমলা ও বরাহি | দ্বারপালিকা — ভূদেবী ও শ্রীদেবী | সারথি অর্জুন আর রক্ষক জয়দুর্গা | লাল রঙের ঘোড়া চারটির নাম রচিকা, মোচিকা‚ জিতা ও অপরাজিতা |
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় শুরু হয় ‘পাহাণ্ডি’(পাহাণ্ডি হল জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি তিনটিকে গর্ভগৃহ থেকে বার করা ও পুনরায় প্রবেশ করানোর সময় বিশেষ কৌশলে মূর্তিগুলোকে দোলানো)। রথ এসে পৌঁছয় বড়ডাণ্ডয় (মন্দিরের সামনের বড় রাস্তা)। রাজা গজপতি উত্তর দিকের পথ সোনার ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দেওয়ার পর রথ চলা শুরু করে। প্রথমে রথ যায় গুণ্ডিচা মন্দির (গুণ্ডিচা ছিলেন দারুব্রহ্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রানি)। সেখান থেকে মাসির বাড়ি | মোট পথ ২ কিমি | আবার উল্টো রথের দিন (নবম দিন বা দশমী) ‘গোটে পাহাণ্ডি’ প্রক্রিয়ায় গর্ভগৃহে এসে পৌঁছায় এই তিন মূর্তি | এইভাবে সমাপ্ত হয় রথযাত্রা |