জয়ন্ত ঘোষাল
করোনাকালে দিল্লিতে মানুষের কী শোচনীয় অবস্থা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল।
নমস্কার আমি চিটেগুড় স্কুপওয়ালা বলছি।
বেশ কিছুদিন দিন আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।
এ জন্য আমি দুঃখিত। ক্ষমাপ্রার্থী।
আসলে করোনা আক্রান্ত সময়ে রাজনীতি কভার করতে গিয়ে নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে গেছিলাম।
এখন এই পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে যে, আপনাদের কিছু কথা জানানো দরকার। তা না হলে আমি চিটেগুড় স্কুপওয়ালা এ জীবনে হলাম কেন?
করোনা পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর সবথেকে প্রথমে দুটো ওষুধ ডাক্তারবাবু অবিলম্বে কিনে খেতে বললেন। দিনে দুটো করে পাঁচ দিন খেতে হবে পাঁচটা ওষুধ। দিল্লিতে লকডাউন চলছে, এতদসত্ত্বেও আমি হলাম চিটেগুড় স্কুপওয়ালা। আমাকে রাস্তাঘাটে আটকায় কে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে যে আমি তো ওষুধের দোকানে যাচ্ছি। ওষুধের দোকানে গেলাম, লাইনে দাঁড়ালাম সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। কিন্তু ওষুধ নেই। বললো বেশ কয়েক মাস ধরে এই ওষুধগুলোর সাপ্লাই নেই, যেগুলো করোনা সময়ে মানুষের জরুরি প্রয়োজন। কেন নেই? তাহলে কি সব ওষুধ হাসপাতালে চলে গেছে?
আমি চিটেগুড় স্কুপওয়ালা। এত বড়ো একটা সাংবাদিক। আমি পদ্মবিভূষণ পেয়েছি। আর আমাকে কি না রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওষুধ না নিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হবে। তবে রিপোর্টার হলাম কেন? রিপোর্টার মানেই তো vip, রিপোর্টার মানেই তো ক্ষমতাশালী। আমরা অন্য লোকের ব্যবস্থা করে দেই আর নিজের বেলাতে পারবো না, এ কেমন কথা।
সবথেকে প্রথম কল করলাম ডাক্তার বাবুকে। ডাক্তার আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক। তিনি জানালেন, প্রথমত হচ্ছে যে, আমাদের দেশ ওষুধ উৎপাদনে একটা অন্যতম দেশ। আমরা যা উৎপাদন করি, তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে export হয়। কি গর্বের কথা! স্বনির্ভর ভারত। কিন্তু যখন এরকম একটা সংকট, তখন ওষুধ কোথায়? সেই ওষুধ শিল্প, প্রাইভেট যেসব কোম্পানি তারা কি ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে? যখন প্রয়োজন তখনই তো উৎপাদন বেশি দরকার। তাহলে কি লকডাউনের জন্য কারখানা বন্ধ? না ওষুধের হোর্ডিং করছে অসাধু ব্যাবসায়ীরা। এটা তো চিরকাল ভারতে হয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই, কলেজ জীবন থেকেই লিখে আসছি এবং পড়ে আসছি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র আজও কেন বুঝতে পারছে না যে, সমরাস্ত্রের থেকে বেবি ফুড উৎপাদন হওয়া বেশি জরুরি।
কথাটা সহজ কথা কিন্তু সেটা কিছুতেই মানুষকে বোঝানো গেল না। ঠিক সে রকমভাবে জীবন দায়ী ওষুধ সংকটের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ, তার বণ্টন ব্যবস্থা কেন থাকে না। সেটা গোপনে লুকিয়ে রাখে কারা? শুধু যারা ক্রেতা , তাঁরা কি জমিয়ে রাখছে।নাকি যারা বিক্রেতা তারা এটাকে জমিয়ে রেখে কালো ধান্দা করছে।
এবার আসা যাক অক্সিজেন প্রসঙ্গে। অক্সিজেনের যে অক্সানোমিটার, সেই অক্সিমিটার বলছে যে অক্সিজেনের আধার। সুতরাং আমি এবং আমার পরিবারের অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা আছে। সুতরাং অনেকে বললো অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রাখা ভালো। কিন্তু জমিয়ে রেখে লাভ কি? প্রয়োজন হলে তবেই তো মানুষ কিনবে।
ফোন করলাম, বললো, অসম্ভব এখন কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন অক্সিজেন সিলিন্ডার কেউ যদি হাতে করে নিয়ে যায় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। এ রকম একটা অবস্থায় তাহলে অক্সিজেনের সংকট কেন? হসপিটালগুলোতে অক্সিজেনের জোগান দেওয়া যাচ্ছে, আর সাধারণ ভাবে অক্সিজেন আসবে কোথা থেকে। আমাকে আমার চিকিৎসক বললেন, একবার এক রোগী দেড় লাখ টাকা দিয়ে চীনা অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনেছিলেন, তবে সেটার কোনো গ্যারান্টি ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই চীনে প্রযুক্তির কাছে নির্ভর করতে হচ্ছে। তা-ও ব্ল্যাক মার্কেটে। এটা কি স্বনির্ভর ভারত।
তারপর অক্সিজেন প্রস্তুত করে যে সব কোম্পানি তারা কোথায়, তারা কি করছে? এখন জানা গেল যে, আসল কারণ হল পুরোনো প্রথম ওয়েবটা চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ওয়েব যে আসতে পারে, এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করলেও আমাদের মধ্যে একটা complacency এসেছিল। আমাদের মনে হচ্ছিলো নরেন্দ্র মোদি এত সাংঘাতিক বলে দিয়েছে যে, আর করোনা আসবে না।
কিন্তু এরপর যে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে এল এবং সেই ভয়ঙ্কর অবস্থাতে অক্সিজেনের যে এরকম সংকট হবে ভাবা যায়নি। এখন সিঙ্গাপুর থেকে অক্সিজেন আসছে, আমেরিকা থেকে অক্সিজেন আসছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আমেরিকার নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলছে যে, অক্সিজেনের এখনই যদি যোগান হয়, তা না হলে দেশে নিউ বিদ্রোহ হতে পারে। জার্মানি থেকে অক্সিজেন আনার কথা হচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে যে, সংকটের সময় প্রয়োজনীয়তাটা বেশি অনুভব করা হয়, কিন্তু আগে থেকেই তার ব্যবস্থাপনা করে রাখা সেটাই তো সবথেকে বড়ো সুশাসন। তবে কি জানেন আমি তো একজন সৎ একনিষ্ঠ সাংবাদিক, তাই আমি এটুকু বলতে পারি এই যে, বিজেপি প্রমাণ দিয়েছে দেশের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সত্যিই কি প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন?
দিল্লির কোনো হসপিটালে বেড নেই। কাউকে কোনো বেড দেওয়া যাচ্ছে না। কিছু রোগী যাদের টাকা পয়সা আছে তারা অ্যাম্বুলেন্সে করে মিরাট কিংবা ফরিদাবাদে চলে যাচ্ছে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার জন্য।
দিল্লি ভারতের রাজধানী, সেখানে যদি এই রকম অবস্থা হয় তাহলে ভারতের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষ কিভাবে আছে সেটা ভাবলে আতঙ্ক হচ্ছে। তবে একটা জিনিস হাসপাতালে যারা ভর্তি হতে পারছে না অথচ ভর্তি হওয়া দরকার, অক্সিজেনের অভাব এবং নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে,তাদের এখন গৃহ বন্দি হয়ে ঈশ্বরের নাম জপ করা ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প খোলাই নেই।
এরকম একটা অসহায় অবস্থা, চিকিৎসকদেরও কিছু করার নেই। প্রতিনিয়ত চিকিৎসকদের কাছে ফোন আসছে অক্সিজেন কমে গেছে ডাক্তার বাবু কি একটা করুন। দিল্লি তো vip নগরী কারো মা, কারো বাবা কোথায় হসপিটালে অক্সিজেন দেওয়া কিন্তু এখন সে সমস্ত সিস্টেমও ফেল করে যাচ্ছে। কি কান্ড! এখন এই রকম পরিস্থিতিতে আত্মমূল্য ভারত এই শব্দটাই কি রকম যেন মনে হচ্ছে যেন বিদ্রুপ করছে।
কিন্তু আমি হলাম চিটেগুড় স্কুপওয়ালা এই সমস্ত নেতিবাচক কথা দিয়ে মানুষকে রাগিয়ে কোনো লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। তার থেকে বরং বলতে হবে, যেভাবে আমরা থালা বাসন বাজিয়েছি , যেভাবে হাততালি দিয়েছি, সেইভাবে আবার নতুন কিছু একটা পদ্ধতি নিয়ে আসবো যার ভিত্তিতে আমাদের অন্তত মনে হবে আমরা সংকট থেকে দূর হয়ে গেছি।
সংকটটা দূর হোক বা না হোক। সঙ্কট থেকে দূর হয়ে গেছি এইভাবে. ভাবাটাই তো সব থেকে বড়ো কথা।
দেশনায়ক আমাদের সে ভাবে ভাবাতে সফল হবেন না ? এ আমি বিশ্বাস করিনা !!
ফেসবুক থেকে নেওয়া।