বহুদিন ধরেই আশঙ্কা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। আগামী ৭ বছরের মধ্যে তা সত্যি হতে চলেছে। বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘নেচার কমিউনিকেশন জার্নাল’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই গ্রীষ্মকালে বরফশূন্য হয়ে পড়বে সুমেরু মহাসাগর(Arctic Ocean)।
সুমেরু বা উত্তর মেরু বললেই প্রথমে যেটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হল বরফের পুরু চাদরে মোড়া এক শ্বেতশুভ্র মেরু অঞ্চল। যেখানে সুমেরু সাগরের একটা বড় অংশও বরফের চাদরে মোড়া থাকে।
নীল জলরাশির মধ্যে ভাসমান বিশাল বিশাল হিমশৈল, কিংবা সমুদ্রের উপরিভাগ বরফের চাদরে ঢেকে থাকা, উত্তর আটলান্টিক এবং সুমেরু মহাসাগরের এই ছবি ক্রমশ হারিয়ে যাবে।
টাইটানিক জাহাজ ডুবির কথা আমরা জানি। হ্যাঁ আজ থেকে ১০০ বছর আগে আটলান্টিকে ভাসমান এমনই এক হিমশৈলের ধাক্কায় ডুবতে হয়েছিল বিশালকায় জাহাজ টাইটানিককে।
সুমেরু মহাসাগর, গ্রিনল্যান্ড এবং কানাডার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে দ্রুত হারে বরফ গলা নিয়ে গত কয়েক দশক ধরেই সতর্ক করে আসছেন গবেষকরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন দ্রুতহারে বরফ গলছে। এর জন্য শুধুমাত্র বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিই দায়ী নয়, দায়ী উষ্ণ সমুদ্রস্রোতও। সাধারণত উত্তর আটলান্টিক এবং মেরু অঞ্চলে শীতল সমুদ্রস্রোতের দেখা মেলে। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে সমুদ্রের জল উত্তপ্ত হওয়ার ফলে মেরু অঞ্চলে সমুদ্রস্রোতের উষ্ণতাও ক্রমশ বাড়ছে। এই কারণে সমুদ্রে মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা ভাসমান হিমশৈল এবং হিমবাহগুলি দ্রুত ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে।
আর্কটিকে বরফ গলে যাওয়া নতুন কোনও ব্যাপার নয়। এটি যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। প্রতি বছর গরমের সময় আর্কটিকের বরফের চাদরের একটা বড়ো অংশ গলে যায়। আবার শীতকালীন তুষারপাতে তা ঢেকে যায়।
কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে। ১৯৭৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সংগৃহীত বিভিন্ন উপগ্রহ চিত্র এবং জলবায়ু মডেল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গরমকালে যে পরিমাণ বরফ গলছে, শীতকালীন তুষারপাতে তার এক-তৃতীয়াংশও পুনরুদ্ধার হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রতি বছর আর্কটিকের বরফের চাদর একটু একটু করে সংকুচিত হচ্ছে।
এই হিসেব মেনেই, ২০৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ সুমেরু মহাসাগর বরফহীন হয়ে পড়বে। তবে বরফ একেবারে হারিয়ে যাবে না। শীতকালে তুষারপাতের সময় কিছুটা বরফ দেখার সৌভাগ্য হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে সেটাও দেখা যাবে ২০৫০-এর দশক পর্যন্তই। তারপর সুমেরু মহাসাগর ভারত কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের মতো চেহারা নেবে।
বরফশূন্য আর্কটিক গ্রিনল্যান্ড ও উত্তর-পশ্চিম কানাডার স্থানীয় জনজাতিদের সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেবে। ব্যাহত হবে তাঁদের জীবন-জীবিকা। সেইসঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে একাধিক প্রজাতিও।
বলা যায়, বড়সড় পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে পৃথিবী।
দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক সেউং-কি মিন বলেছেন, “গ্রীষ্মে আর্কটিক একদম বরফ শূন্য হয়ে যাবে, এমন একটা বিষয় নজরে আসার পর আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম। গ্রীষ্মে যখন আর্কটিক বরফ শূন্য হয়ে পড়বে, তখন শীতকালে বরফ জমার গতি ধীর হয়ে পড়বে।”
প্রথম দিকে শুধু সেপ্টেম্বর মাসই হয়তো বরফমুক্ত থাকবে। তারপর ধীরে ধীরে তা গোটা গ্রীষ্মকালের জন্যই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হবে। এমনকী অদূর ভবিষ্যতে শীতকালেও আর্কটিকে বরফ কম দেখা যাবে।
ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, যদি বর্তমান হারে জ্বালানি তেল পোড়ানো হয় এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী অন্যান্য কার্যকলাপ চলতে থাকে, তবে ২০৮০ সাল নাগাদ পুরোপুরি বরফহীন হয়ে যাবে আর্কটিক সাগর। আগামী দিনগুলিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে উত্তর মেরু হয়ত এর অনেক আগেই বরফহীন হয়ে পড়বে।