শুভদীপ রায় চৌধুরী
কলকাতার ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ উঠলেই যাঁর কথা সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী। এই সাবর্ণ বংশের সূচনা নবম শতাব্দীতে হলেও, রায় চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত সাবর্ণদের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই লক্ষ্মীকান্তের হাত ধরেই। কলকাতার প্রথম জমিদার হিসেবে পাকা রাস্তা নির্মাণ থেকে শুরু করে পাকা দ্বিতল বাড়ি তৈরি, সনাতনী পূজা প্রচলন, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন কালীঘাটে জন্ম হয় মা কালীর বরপুত্র লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের, পরবর্তীকালে যিনি লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ছিলেন।
৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের মহারাজা আদিশূর পুত্র্যেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য কনৌজ থেকে পাঁচ জন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন এবং এই পঞ্চ ব্রাহ্মণের পাশাপাশি এসেছিলেন পাঁচ ক্ষত্রিয়। এদের মধ্যে বেদগর্ভ ছিলেন সাবর্ণ বংশের প্রথম পুরুষ। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাঘব উপাধ্যায় গঙ্গগ্রামের জমিদারি লাভ করেন। সেই থেকে গঙ্গগ্রামের জমিদাররা গঙ্গোপাধ্যায় পদবীতে ভূষিত হন। তাই সাবর্ণ বংশের পদবি গঙ্গোপাধ্যায় এবং উপাধি রায়, চৌধুরী ও মজুমদার।
লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী ছিলেন সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের ২২তম বংশধর। তিনি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন বিকাল ৪.১৫ মিনিটে জন্মগ্রহণ করেন কালীঘাটে। তাঁর পিতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন হালিশহরের বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত এবং বিদ্যা বাচস্পতিও। জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী দেবী কোনও সন্তান না হওয়ায় কালীক্ষেত্রে সাধনা করার সিদ্ধান্ত নেন। কালীঘাটে তাঁদের কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী কৃপা করেন এবং সতীখণ্ডের সন্ধান দেন। জিয়া তখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তথা সাবর্ণ বংশের কুলগুরু সাধক আত্মরাম ব্রহ্মচারীকে সেই খবর দেন। তখন সাধক আত্মারাম সেই সতীখণ্ড উদ্ধার করেন এবং স্নানযাত্রার দিন তা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৫৭০ সালে সুলক্ষণ যুক্ত পুত্র সন্তানের জন্ম লক্ষ্মীপুজোর দিন হওয়ায় নাম রাখা হয় লক্ষ্মীকান্ত। তাঁর জন্মের ৩ দিনের মধ্যে লক্ষ্মীকান্ত মাতৃহারা হন। জিয়া, স্ত্রী পদ্মাবতীর মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাহত হয়ে, পার্থিব জীবন ত্যাগ করে তপস্বী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন শিশুটিকে বংশের কুলগুরু ঠাকুর আত্মারাম ব্রহ্মচারী দেখাশোনা করেন এবং কামদেব ব্রহ্মচারী উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে চলে যান। ১৩ বছর বয়সে উপনয়নের পর মাত্র ১৫ বছর বয়সেই লক্ষ্মীকান্ত সংস্কৃত কাব্য সাহিত্য, সংস্কৃত ব্যাকরণ, আরবি, ফারসি ইত্যাদি বিষয়ে পাণ্ডিত্যলাভ করেন। তারপরই তিনি বংশের কুলগুরু আত্মারাম ব্রহ্মচারীর থেকে শক্তিপূজা শেখেন ও শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হন।
১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যযুগীয় বাংলার যশোর এস্টেটের রাজা বসন্ত রায় পিতৃস্নেহে লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীকে যশোরে নিয়ে যান এবং তাঁকে রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে এস্টেটের কাজে যোগদান করেন। রাজা বসন্ত রায়ের ভাগ্নে প্রতাপাদিত্য এবং লক্ষ্মীকান্ত হাতে হাত মিলিয়ে যশোরকে সমৃদ্ধশালী রাজ্যে পরিণত করেন।
প্রতাপাদিত্য সম্রাট আকবরের খুব প্রিয় ছিলেন। তাঁর পিতা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই একজন অত্যাচারী শাসক হয়ে ওঠেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। লক্ষ্মীকান্ত এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেন এবং এই অনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং মুঘল সম্রাটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। প্রতাপাদিত্য লক্ষ্মীকান্তের কথায় কোনো কর্ণপাত করেননি। খুব শীঘ্রই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে প্রতাপ তাঁর চাচা রাজা বসন্ত রায়কে কলকাতার কাছে হুগলি নদীর তীরে রায়গড় দুর্গে হত্যা করেন।
একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ এবং রাজা বসন্ত রায়ের অনুরাগী হওয়ায় লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপাদিত্যকে আর সহ্য করতে পারেননি। তিনি তাঁর সেবা থেকে ইস্তফা দিয়ে তাঁর জন্মস্থান কালীক্ষেত্রে ফিরে আসেন এবং নিজেকে ধ্যানে নিযুক্ত করেন। যশোর এস্টেটের ঘটনার পালাক্রমে সম্রাট আকবর দুঃখ পেয়েছিলেন এবং প্রতাপাদিত্যের বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্য পাঠান। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছর প্রতিবারই মুঘল বাহিনী প্রতাপকে কোনও শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। ১৬০৫ সালে আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীর পরবর্তী অভিযানে রাজা মান সিংকে বাংলায় পাঠান। সম্রাট প্রতাপাদিত্যের বিদ্রোহের পতনের পর প্রশংসায় লক্ষ্মীকান্তকে একটি হীরার আংটি উপহার দেন।
সম্রাট হুমায়ুনের সময় থেকেই মুঘল ও সাবর্ণ পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক আজও বর্তমান। লক্ষ্মীকান্তের পিতামহ পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে পঞ্চু শক্তি খান ছিলেন মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের নিকটতম সহযোগীদের মধ্যে একজন। মুঘল সম্রাট পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজে খুশি হয়ে তাঁকে শক্তি খান উপাধি দেন, তিনিই হালিশহর সমাজের প্রতিষ্ঠাতা।