হোমPlot1কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস

কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস

কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস

শুভদীপ রায় চৌধুরী
বঙ্গদেশ কালীক্ষেত্র, শক্তি সাধনার পীঠস্থান। কৃষ্ণ ও শিব মন্দিরের পাশাপাশি এই পীঠে শক্তি আরাধনা বিশেষভাবে পরিচিত। আর কলকাতার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ধারাবাহিকতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কালীঘাটের নাম। ঐতিহাসিকদের একাংশের মত, কালীঘাট থেকেই কলকাতা নামের উৎপত্তি। প্রতিবার দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় এই সতীপীঠে। তবে কালীপুজোর দিন মহালক্ষ্মী পূজা হয় কালীঘাটে, এও এক প্রাচীন প্রথা। যুগের পর যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত এই দক্ষিণাকালী, যা বঙ্গের আরাধ্যা।

দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা (কালীঘাটের দক্ষিণবর্তী রাজপুরের কিছু দক্ষিণ পূর্ব আকনা গ্রামের সন্নিকট স্থান বোলপুর নামে খ্যাত) পর্যন্ত দুই যোজন এলাকাই কালীক্ষেত্র। এর মধ্যে এক ক্রোশ পরিমিত ত্রিকোণাকার ক্ষেত্রের মধ্যেই দেবী কালিকা বিরাজমান, যেখানে নকুলেশ ভৈরব এবং গঙ্গা বিরাজ করেন। কাশীক্ষেত্র ও কালীক্ষেত্র উভয়ের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। এই মহাপুণ্যস্থানে ভৈরবী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা, ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী ও চণ্ডী এই সনাতনী অষ্টশক্তি অবস্থান করেন।

যে জায়গাটিকে এখন কালীঘাট বলা হয়, বিশেষ কোনও প্রাচীন নাম না থাকলেও, তা যে পুরাণের “সমতট” প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ভূতত্ববিদ পণ্ডিতেরা দক্ষিণ বাংলার রসাতল প্রবেশের বিষয়ে প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, কলকাতি ও তার কাছে জায়গাগুলি ক্রমশ নীচের দিকে এগিয়ে গেছে। এইসব প্রাচীন ক্ষেত্রগুলি ওপর দিক থেকে অনেকটাই বসে গেছে। এতেই বোঝা যায়, যে স্থানটি এখন কালীঘাট হিসেবে চিহ্নিত করা আছে, তার অনেক নীচের জমিতে অনেকদিন আগে মানুষেরা বসবাস করতেন। ক্রমশ রসাতল নীচে চলে যাওয়ায় জায়গাটি মানবশূন্য হয়ে যায়। ফলে এই জায়গাটি আবার মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠতে সময় লাগে।

ভবিষ্যপুরাণীয় ব্রহ্মখন্ডে লিখিত আছে, “গোবিন্দপুর প্রান্তে চ কালী সুরধুনী তটে।” অর্থাৎ, কালীক্ষেত্র কালীঘাট বহু প্রাচীন তীর্থস্থান। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বহু তীর্থ বিষয়ক গ্রন্থে কালীঘাটের নামোল্লেখ করে দেবী কালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। কিছু তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় কালীঘাট বা কালীঘট্ট বা কালীক্ষেত্র বল্লাল সেন যুগেরও প্রাচীন।

কালীঘাটের এই মন্দির সৃষ্টি ও মূর্তি স্থাপনের ব্যাপারে বাংলার প্রাচীন জমিদার বংশীয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারই উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন ১৫৬৯সাল থেকে। কথিত আছে,
“লক্ষ্মীর আরাধ্য কালী, যাহে স্থিরামতি।
  অদূরে বড়িশা তথা করিল বসতি।
  যথাকালে কালীঘাটে কালিকার স্থিতি।
  লক্ষ্মীনাথে কুলভাঙ্গে সাবর্ণে মতি।।
  মানসিংহ গুরুপুত্র করে অন্বেষণ
  কালীঘাটে পায় নাম লক্ষ্মীনারায়ণ….।।”

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাচীন কৃষ্টিসম্পন্ন জমিদারবংশ। ৯৭৭ বঙ্গাব্দের (১৫৭০ সাল) এই দিন বিকেল ৪.১৫ মিনিটের সময় এই কালীঘাটেই লক্ষ্মীকান্তের জন্ম হয়। লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন জন্ম বলে নাম লক্ষ্মীনারায়ণ বা লক্ষ্মীকান্ত। লক্ষ্মীকান্তের জন্মের আগে কামদেব ওরফে জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীদেবীর সন্তান না হওয়ায় আত্মীয়-স্বজন বললেন, কালীঘাটে গিয়ে তাঁদের কুলদেবী কালিকার কাছে পুত্রকামনায় তিনদিন তিনরাত্রি সাধনার জন্য। তৃতীয় দিন রাতে কালীমন্দিরের পুষ্করিণীর জলের ওপর এক আলোর ছটা দেখতে পান পদ্মাবতীদেবী। পরদিন ওই পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তিনি জলের তলায় সতীর দেহাংশ দেখতে পান এবং দৈববাণী শ্রবণ করেন। সেই দৈববাণী শুনে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তথা সাবর্ণ বংশের কুলগুরু আত্মারাম ঠাকুর পুকুরের তলা থেকে দেবীর সতীঅংশের উদ্ধার করেন। ১৫৭০সালে আষাঢ় মাস স্নান পূর্নিমা তিথিতে একটি লাল পট্টবস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হন দেবী কালিকা। শুরু হয় সতীর নিত্য পূজাপাঠ।

১৫৬৯সালে হালিশহর থেকে সাবর্ণ গোত্রীয় দম্পতি যখন কালীঘাটে এলেন তখন এই সতীপীঠের প্রধান পুরোহিত মহাযোগী শ্রীমৎ আত্মারাম ঠাকুরের থেকে তন্ত্রমতে দীক্ষা নেন জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় এবং পদ্মাবতীদেবী। 
লক্ষ্মীকান্তের জন্মের পর তাঁর মা পদ্মাবতীদেবী মারা যান। লক্ষ্মীকান্তকে কালীঘাটে রেখে কামদেব বেরিয়ে পড়েন সাধনার উদ্দেশ্যে। শেষে তিনি কাশীতে পৌঁছন এবং কামদেব ব্রক্ষ্মচারী নামে ভারত বিখ্যাত সাধকে পরিণত হন। কামদেবের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত বাড়তে থাকেন তাঁর কুলগুরু আত্মারাম ঠাকুরের কাছে।

পরবর্তীকালে বঙ্গে প্রতাপাদিত্যকে দমন করে মানসিংহ লক্ষ্মীকান্তের বিদ্যাবত্তা এবং যশোর তালুকের নায়েব থাকাকালীন প্রশাসনিক ও সামরিক দক্ষতার বিষয়ে অবগত হন। সেই সমস্ত কথা শুনে মানসিংহ কালীঘাটে লক্ষ্মীকান্তের সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে বলে যে তাঁর পিতা কামদেবের শিষ্য তিনি(মানসিংহ), পিতার নির্দেশেই তিনি তা‌ঁকে (লক্ষ্মীকান্তকে) গুরুদক্ষিণা প্রদান করতে চান। লক্ষ্মীকান্তের ব্যবহার, পাণ্ডিত্য, উপস্থিতবুদ্ধি দেখে অভিভূত হয়ে মানসিংহ তাঁকে “মজুমদার” (রাজস্ব কমিশনার) পদমর্যাদায় ভূষিত করলেন।

কালীক্ষেত্রের কালীমূর্তির প্রথম আবিষ্কারের বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমান কালীমন্দিরের অনতিদূরে পর্ণকুটীরে কোন ব্রাহ্মণ বাণপ্রস্থ অবলম্বনপূর্বক তপস্যা করছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় ভাগীরথী সলিলে সন্ধ্যা বন্দনাদি পাঠ করছেন। এমন সময় অনতিদূরে এক আলোকজ্যোতির সন্ধান পান। সেই আলোকজ্যোতি দেখে ব্রাহ্মণের কৌতুহল বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ওই কালীকুণ্ডে গিয়ে দেখেন দিব্য আলো নিঃসৃত হচ্ছে। পরে কালীর প্রত্যাদেশ মতে জানতে পারেন যে, পূর্বকালে সুদর্শন ছিন্ন হয়ে তাঁরই অঙ্গ ওখানে পতিত হয়েছিল। তখন সেই ব্রাহ্মণ অনুসন্ধান করতে করতে অদূরে স্বয়ম্ভু নকুলেশ্বর রয়েছেন দেখতে পান এবং তিনি ওই স্থানে উক্ত প্রস্তরবৎ সতীঅঙ্গ যত্নপূর্বক রেখে কালীমূর্তি ও নকুলেশ্বরের পুজো করতে শুরু করেন।

আবার অন্যমতে, ব্রহ্মানন্দগিরি এবং আত্মারাম ঠাকুর মহামূল্যবান কষ্টিপাথরে দক্ষিণাকালী মাতার রূপদান করেছিলেন সাবর্ণ গোত্রীয় রায় চৌধুরীদের কুলমাতা মা ভুবনেশ্বরীর রূপদেখে ১৫৭০সালে। ওই শিলার মধ্যেই দেবী-কালিকা আবদ্ধা আছেন। কালীঘাট পুণ্য পীঠস্থানরূপে আত্মপ্রকাশের মূলে রয়েছেন মহাতপস্বী দুই সাধক আত্মারাম ঠাকুর এবং ব্রহ্মানন্দগিরি। আর রয়েছেন কামদেব ও পদ্মাবতীদেবীর সাধনা ও স্বপ্নাদেশ। শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “প্রাচীন কলিকাতা” বইতে লিখেছেন, পনেরোশ শতাব্দীর শেষভাগে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গোবিন্দপুএ(তখনকার কালীঘাট) মা কালীর পূজার্চনা শুরু হয়। এক্ষেত্রে আরও একটি কথা উল্লেখ্য যে সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়(রায় চৌধুরী) মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে জায়গির প্রাপ্তির পর তিনিই  কালীঘাটের মন্দির তৈরি ও দেবীর সেবার জন্য ব্যবস্থা করে দেন।

লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী ৫৯৫ বিঘা ৪ কাঠা ২ ছটাক জমি দান করেছিলেন দেবীর সেবার জন্য। শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় আরও উল্লেখ করেন, গোবিন্দপুরের পুরনো নাম কালীঘাট এবং বর্তমানে যেখানে জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস) আছে সেখানেই ছিল মা কালীর মন্দির। প্রমথনাথ মল্লিক তাঁর “কলিকাতার কথা” বইতে লিখেছেন, কালীদেবী কবে কলকাতা হইতে কালীঘাটে যান তাহার সবিশেষ তথ্য অবগত হওয়া দুরূহ তবে এই পর্যন্ত শোনা যায় বর্তমান পানপোস্তার উত্তরে দেবীর মন্দির ও পাকা ঘাট ছিল। সেই পুরাতন পাথরে বাঁধান ঘাট হইতে বর্তমান পাথুরিয়াঘাটার নাম হয়েছে যদিও এই মতেরও বিরুদ্ধাচরণ করেছেন ধর্মানন্দ মহাভারতী।

ব্রহ্মানন্দের জন্মের আগে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের “মনসা বিজয়”ও সমসাময়িক কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গলে” কলকাতা এবং কালীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। এইরূপ প্রবাদ আছে যে, বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরী গোষ্ঠী বাংলার দক্ষিণ অংশের জমিদারি প্রাপ্ত হয়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির আবিষ্কার করেন।

কালীর সেবায়েতগণের মধ্যে ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী,  কুলব্রহ্মচারীর নাম প্রথম পাওয়া যায়। ভুবনেশ্বর যোগ সাধনায় রত থাকতেন এবং পীঠস্থান নির্জন কালীঘাটে গঙ্গাতীরে বসে কালীর সেবা করতেন। একদিন এক গরিব বিধবা ব্রাহ্মণী মন্দিরে দেবীদর্শনে আসেন। সঙ্গে অষ্টাদশী অবিবাহিত কন্যা, নাম যোগমায়া। ভুবনেশ্বরগিরি এই কন্যার রূপসৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভৈরবীরূপে গ্রহণ করেন। তন্ত্রে ভৈরবী রাখার নির্দেশ আছে। কিছুদিন পরে যোগমায়া এক কন্যার জন্ম দেন। নবজাতা শিশুকন্যার নাম রাখলেন উমা। উমার সাথে খানিয়ান গ্রাম নিবাসী ভবানীদাস চক্রবর্তীর বিবাহ হয়। কারণ ভুবনেশ্বরগিরি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অদ্ভূত দৈববানী পান- “বৎস, ভুবনেশ্বর এবার উমার বিয়ে দিয়ে আমার পূজা কর। সন্ন্যাসীদের রেহাই দিয়ে সংসারীর হাতে তুলে দে।”

ভুবনেশ্বর গিরির অনুরোধে ভবানীদাস কালীঘাটে থেকে গেলেন। দেবীর পূর্বের আদেশমতোন ভুবনেশ্বরগিরি বৈষ্ণব ভবানীদাসের ওপর দক্ষিণা কালিকার পূজা-আরতির ভার দিলেন। তখন থেকেই শুরু হয় গৃহীভক্তের হাতে কালীর পূজার্চনা। সন্ন্যাসী ভুবনেশ্বরগিরিই কালীঘাটের শেষ মোহান্ত। কালীঘাটের বর্তমান মন্দির তৈরী করেন বড়িশার সাবর্ণ গোত্রীয় সন্তোষ রায় চৌধুরী, সন ১২০৯ সালে। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে দাখিলী ভূমির দলিলে দেখা যায় যে, ১১৫৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৭৫১ সালে মনোহর ঘোষাল ও কালীঘাটের তদানীন্তন সেবাইত গোকুলচন্দ্র হালদারকে সন্তোষ রায় চৌধুরী জমিদারীর নানাস্থানে বিস্তর ভূমি দান করেন।

২৪ পরগণায় সন্তোষ রায়ের অসীম প্রভুত্ব ছিল। সন্তোষ রায় তদানীন্তন দক্ষিণ প্রদেশের সমাজ অধিপতি ছিলেন। শেষ অবস্থায় সন্তোষ রায় কালীঘাটের কালীর বর্তমান বড় মন্দির নির্মাণ করেন। সন্তোষ রায়ের মৃত্যুর পর প্রায় ৫।৬ বৎসর পরে সাবর্ণ কুলতিলক রাজীবলোচন রায় চৌধুরী ১৮০৯সালে কালীঘাটের বর্তমান মন্দির স্থাপন করেন।

বড়িশার সাবর্ণি জমিদারদের পূর্ব পুরুষ কেশবচন্দ্র রায় চৌধুরী গঙ্গাতীরে আপন জমিদারির অরণ্য মধ্যে জপদি করতেন। কালীঠাকুরাণীর প্রত্যাদেশ মতে বর্তমান কালীর প্রস্তর খোদিত মুখমণ্ডল প্রাপ্ত হয়ে ওই কুণ্ডুর পশ্চিম তীরে স্থাপন করেন এবং কালীর সেবার জন্য উক্তস্থানের জমি নির্দিষ্ট করে দিয়ে মনোহর ঘোষাল নামক এক ব্যক্তিকে পরিচারক নিযুক্ত করেন। কালীঘাটের বন কেটে তিনি কালীর ইমারত নির্মাণ করে দেন। যে স্থানটিকে এখন কালীঘাট বলা হয় তা পূর্বে বড়িশার প্রসিদ্ধ ভূম্যধিকারী সাবর্ণি চৌধুরীদের জমিদারি ভুক্ত চাঁদপুর গ্রাম বলেই পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার কেশবচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয়ের ভ্রাতা কাশীশ্বর রায় চৌধুরী ওই স্থানে একটি ক্ষুদ্র মন্দির নির্মাণ করেন।

কালীঘাটের মন্দিরের মধ্যে এখন কেবল কালীর প্রাপ্ত মুখমণ্ডল প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এমন নয়, এখন সোনায় নির্মিত, বহুমূল্যের অলঙ্কারাদিও রয়েছে। এইসমস্ত অলংকার বহু ধনাঢ্য লোকের প্রদত্ত। প্রথমে খিদিরপুর নিবাসী স্বর্গীয় দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল মহাশয় কালীর চারিটি রৌপ্যময় হস্ত করে দেন। বর্তমান চারটি স্বর্ণ নির্মিত হাত প্রদান করেন কলকাতার প্রসিদ্ধ বাবু কালীচরণ মল্লিক মহাশয়। চারহাতের চারগাছি সুবর্ণ কঙ্কণ চড়কডাঙা নিবাসী কালীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদান করেন। কালীর স্বর্ণজিহ্বাটি পাইকপাড়াধিপতি রাজা ইন্দ্র চন্দ্র সিংহ বাহাদুর প্রদান করেন। এইরূপ বহু স্বর্ণালংকার বহু ধনাঢ্য লোকের দ্বারা প্রদান করে।

কালীর মন্দিরের পশ্চিম দিকে শ্যামরায় বিগ্রহের অধিষ্ঠান মন্দিরও দোলমঞ্চ। কালীর সেবায়েতদের পূর্বপুরুষ ভবানীদাস বৈষ্ণব ছিলেন। শ্যামরায় বিগ্রহ তিনি কালীঘাটে নিয়ে আসেন। ১৭২৩ সালে মুর্শিদাবাদের জনৈক কাননগু কালীঘাটে এসে শ্যামরায়ের জন্য ছোটো ঘর প্রস্তুত করে দেন। ১৮৪৩ খ্রীঃ বাওয়ালীর জমিদাণের পুর্বপুরুষ উদয়নারায়ণ মণ্ডল মহাশয় শ্যামরায়ের ছোটো ঘর ভেঙে বর্তমান মন্দির নির্মাণ করে দেন। দোলযাত্রার দিন শ্যামরায়ের প্রধান উৎসব। পূর্বে শ্যামরায়ের দোলমঞ্চ ছিল না তাই মন্দিরেই দোল পালন করা হত। ১৮৫৮ খ্রীঃ সাহানগর নিবাসী মদন কলে নামক এক ব্যক্তি শ্যামরায়ের দোলমঞ্চ নির্মাণ করেন।

ঐতিহাসিক অতুলকৃষ্ণ রায়ের মতে, সতী-অঙ্গ বর্তমান চৌরঙ্গী অঞ্চলে পড়েছিল, তাই তার নাম চৌরঙ্গী। যদি এই মত সত্য বলে ধরা হয় তাহলে দেবীর মূর্তি ও মন্দির কালীঘাটে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলেই হত। তপন চট্টোপাধ্যায় “পলাশির যুদ্ধ” বইয়ে লিখেছেন, কালীঘাটের ভদ্রকালী কালিকা কালীক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নকুলেশ্বর মহাদেবের সাথে তিনি সানন্দে বিরাজ করছেন। পূর্ণেন্দু পত্রী “ছড়ায় মোড়া কলকাতা”য় লিখেছেন, সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারি মধ্যেই কালীঘাট। বুড়িগঙ্গার তীরে এঁরাই কালীঘাটের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সামাজিক নিয়মে বাঁধে বলে নিজেরা পুজো করতে পারেন না। তাই দূর দেশ থেকে ডেকে আনা হল হালদার গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ। সেই থেকে ঐ হালদাররাই মন্দিরের সেবায়েত।”

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img