বিকাশ পাল, লন্ডন: শুনলাম দ্বিতীয় বার্ষিক কাজলবাবু স্মৃতি বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সুধীর বাবু এসেছেন দশগ্রামে। বয়সের ভারে তিনি অশক্ত কিন্তু মোটেই অনুৎসাহিত নন। আমাদের ট্রাস্টের জন্য আনন্দের কথা। আমার সঙ্গে সুধীরবাবুর পরিচয় ৪০ বছরেরও বেশি, সেই ১৯৮৪ সাল থেকে, যখন আমি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। সুধীরবাবুর মত সর্বংসহা মানুষ আমি কমই দেখেছি। জীবনে তিনি অনেক আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু কোনও আঘাতই তাঁকে আহত করেনি। অনেক দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু ভেঙে পড়েন নি। কথায় বলে না , ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কী, ব্যাঙের আবার সর্দি কী?
সত্যিই তাঁর জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। উনি এক বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। মা আর কাকাকাকীর কাছে মানুষ। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় থানার এক অন্তঃপাতী গ্রাম খুরশি। সেখানেই তাঁদের সামান্য অসন বশন আর জমিজমা । তারই দশ কাঠা বেচে তাঁর কাকা তাঁকে বাংলায় স্নাতক পড়তে পাঠালেন কাঁথির কলেজে। তারপর দু তিন জায়গায় স্কুল শিক্ষকতা করে নিজের স্কুল দশগ্রামে এলেন। তারপর থেকেই বহু বছর ওনার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। আমি কলকাতা থেকে দশগ্রামে গেলে ওনার বাসায় যেতাম, দেখতাম উনি নিজেই বাড়ির সব কাজ করছেন, ৮-১০ বছরের মেয়ে সুকন্যা আর স্ত্রীর দেখাশোনা করছেন। কিন্তু চোখে মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। থাকবে কেন? জীবনকে নিয়ে তাঁর তো কোনও অভিযোগই নেই। এভাবেই তাঁর জীবনের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছরগুলো পেরিয়ে গেছে।
২০০৪ সাল নাগাদ দশগ্রাম ছেড়ে মেদিনীপুর শহরে অবসর জীবন শুরু হোল। খুরশির পৈতৃক ভিটে, বিষয় আশয়, জমিজমা সব ভাইপোদের দিয়ে এখন মেয়ের সাথে শহরবাসী। বছর কয়েক হল স্ত্রী গত হয়েছেন।
সে সব দিনই ছিল আলাদা, না না আমায় নস্টালজিকতায় পায়নি। ১৯৮৫ সালের ফাগুন চৈত্র মাস – সুধীরবাবু তখন সপরিবারে স্কুলের গান্ধী সরোবরের পূর্বদিকে শিক্ষকদের থাকার বাসায় থাকতেন। প্রায় আনকোরা শিক্ষিকা কাবেরী দিদিমনি তখন সবে এসেছেন, একেবারে নতুন। তিনিও পাশের আর একটি বাসায় থাকতে শুরু করেছেন। আমি সুধীরবাবুর বাড়িতে গেলাম।
সেই সময় আমি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতির রাধা আর চণ্ডীদাসের রাধার মধ্যে একটা তুল্যমূল্য আলোচনা লিখেছি, পরীক্ষার জন্য। সেটা একটু এধার-ওধার থেকে পড়াশোনা করে খাড়া করেছি। সুধীরবাবুকে বললাম স্যার, দেখুন এটা একটু। কোথায় কিছু ফাঁকফোকর রইল কিনা। উনি বললেন তুই ঘরের দরজার সামনেই থাক, ওখান থেকেই পড়ে শোনা, আমি বিছানায় বসে শুনবো। আমার জলবসন্ত হয়েছে, তুই আমার থেকে দূরে থাক। তাই করলাম। শুনে বললেন, এত লেখার দরকার নেই। আমি বললাম কেন? এই বলে যা বললেন, তার যতটা মনে আছে ৪০ বছর পর তার চাইতে অনেক বেশি মনে নেই।
কিন্তু যা মনে আছে, সেটা আমি একটু আমার মত করে লিখছি। তিনি বললেন, তোকে চণ্ডীদাস আর বিদ্যাপতির কৃষ্ণ চেতনার মধ্যে যে তফাৎ, সেটা আগে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। দুজনের সময়ের মানুষের ধর্মীয় চেতনার স্বকীয়তার দিকগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। তারপর সেসব চেতনা কীভাবে দুজনের রাধার চরিত্রকে প্রভাবিত করেছে সেখান থেকে শুরুটা যেন হয়। বলে যা বললেন, সেটা কিছুটা এই রকমস: কবিতার লাইন গুলি পুরো মনে ছিল না, আমার লাইব্রেরির সংগ্রহের সাহায্য নিয়েছি।
বিদ্যপতির রাধা বিরহে কাতর, তাঁর বেশি কিছু বলার নেই। খুব বেশি হলে বিরহে তিনি বলেন –
“কত মধু যামিনী রভসে গোঁয়ানু না বুঝনু কৈছন কেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু তবু হিয়া জুড়ন না গেল।”
রাধার এই যে শ্যামকে নিজের মনের মত করে কাছে না পাওয়ার বেদনা, সেটাকেই একটু বলতে হবে, বিদ্যাপতির রাধার জীবনে দুঃখ বিরহ আছে , তবে সেই বিরহ দুঃখের হা-হুতাশের মধ্য দিয়েই তিনি রাধাকে সম্পূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন।
মৈথিল কবি বিদ্যাপতির সময়ের মিথিলার মাটি সরস সবুজ নদী নালায় ভরা। প্রকৃতির এই রূপসজ্জায় একটা সম্প্রীতির ছন্দ মাধুর্য থাকে। সেজন্য বিদ্যাপতি ছন্দের কবি। তিনি প্রেমের পরিপূর্ণতায় শুধু বিশ্বাসই করেননি, সেই পূর্ণতার প্রকাশ করার জন্যও ছন্দেরই আশ্রয় নিয়েছেন। তাই তাঁর কাব্যে এত ছন্দের ছড়াছড়ি।
যেমন তিনি লিখলেন:
“কন্টক গাড়ি কমলসম পদতল মঞ্জির চিরহি ঝাঁপি।
গাগরি বারি ঢারি করি পিছল চলতহি অঙ্গুলি চাপি”
বিদ্যাপতির ছন্দমাধুর্যই রাধার প্রেমকে অমরত্ব দিয়েছে। ইনিই বিদ্যাপতির রাধা, বুঝলি , তিনি পায়ে নূপুর পরে উঠোনে জল ঢেলে কাদায় হাঁটা চলা অভ্যাস করছেন। বৃষ্টিমুখর রাতে যদি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির ডাক আসে, তখন তো কাঁটায় ভর্তি জল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাধাকে হাঁটতে হবে। বিদ্যাপতির রাধা জগতের মধ্যে প্রেমকেই সার মনে করেন। কৃষ্ণপ্রেমের বাইরে তাঁর অস্তিত্ব নেই। তাই এই রাধাকে নিয়ে এখানেই থামতে হয়।
চণ্ডীদাসের রাধা কিন্তু জগতকেই প্রেম মনে করেন। চণ্ডুদাসের রাধা সুখের মধ্যে দুঃখ , দুঃখের মধ্যে সুখকে দেখেছেন। তাই রাধার জীবনে পিরীতি যত, জ্বালাও তত।
রাধা বলেন:
“সুখ দুঃখ দুটি ভাই
সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি
দুঃখ যায় তার ঠাঁই”
অথবা
“বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ।
চণ্ডীদাস কয়, এমতি হইলে
পিরীতির কিবা সুখ!”
প্রেম রাধার কাছে কোনো সুখের আলাদা অনুভুতি নয়। প্রেম যেমন আনন্দ দেয় তেমনি তাঁকে আহতও করে ।
তাই চণ্ডীদাসের রাধার মনে শান্তি কোনোদিনই নেই, কেননা শ্যামের সাথে মিলনে যে আনন্দ তার চেয়ে বেশী তিনি শ্যামকে হারানোর আশঙ্কায় আশঙ্কিতা। জীবনের সমগ্রতা হিসেবেই চণ্ডীদাসের রাধা প্রেমকে দ্যাখেন। এখানে সুখ -দুঃখ আনন্দ-আশঙ্কা সবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তফাৎ করা যায় না।
চণ্ডীদাসের রাধা বলেন:
“সই, কী আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে!
সই, কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া।
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
…
যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!
কৃষ্ণকে হারানোর ভয় যখন তাঁকে পেয়ে বসে , রাধা তাঁর অক্ষমতাকে তাঁর উপর অন্যের ঈর্ষার কারণ হিসেবে দেখেন আর অন্যের দোষ দেন। সেদিক থেকে এই রাধা কিছুটা অবুঝ আর কিছুটা আনাড়ী, যুক্তির ধার ধারেন না। তাই বেশি কিছু না বলেই সরাসরি বলে ফেললেন –
‘আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!’
রাঢ় রুক্ষ্ম বীরভুমের কবি চণ্ডীদাসের চেতনায় রাধা এভাবেই প্রতিফলিতা। তবে এর মধ্যে আমি অপূর্ণতার কিছু দেখছি না। চণ্ডীদাস কবির কবি। তাই তিনি যতটা বলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেন না। আমাদের দিয়ে বলিয়ে নেন। তাঁর রাধা তাই রহস্য। তিনি বহুমাত্রিক। আর সেখানেই তাঁর মহত্ত্ব । তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। সেখানেই চন্ডিদাসের রাধার নতুনত্ব। আর এই জন্যই এই রাধার প্রেম অনেক বেশী রহস্যময় । সে প্রেম জাগতিক নয় , সে প্রেম দর্শন স্পর্শনের অনেক উপরে । তাই যদি না হবে – তবে চণ্ডীদাস কেন লিখবেন।
“রজকিনীরূপ কিশোরীস্বরূপ
কামগন্ধ নাহি তায়,
রজকিনী-প্রেম নিকষিত হেম
বড়ু চণ্ডিদাসে গায়।
সত্যিই কোনো ভোগ উপভোগের ব্যাপার নেই এখানে । কেননা এই প্রেমে কামগন্ধ নাই। তাই তো চন্ডিদাসের রাধা বলেছেন –
রজনী দিবসে হব পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা–
একত্র থাকিব নাহি পরশিব
ভাবিনী ভাবের দেহা।”
এক সাথে থাকবেন কিন্তু দেহ স্পর্শ করবেন না। এত সব শোনার পর আমি সুধীরবাবুকে বললাম, স্যার তাহলে আমরা কি বলতে পারি, চণ্ডীদাসের রাধার প্রেম ত্যাগের আর বিদ্যাপতির রাধার প্রেম ভোগের ? স্যার হেসে বললেন, ব্যাপারটা এতটা সহজ হলে তো তুই আমিও চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি হয়ে যেতাম। আজ আর নয় বলে বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে দাঁড়ালেন ।
তারপর চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এই সেদিন কাজলবাবুর ৭৫ তম জন্মদিনে সুধীরবাবুর কথা শুনলাম। বললেন বিকাশ, তোদের কাজলের নামে ট্রাস্টে তোরা যে আমাকে কাজলের উপর বলতে বলেছিস সেজন্য আমি সম্মানিত। আর তোরা যে আমার নামে স্কুলে একটা বাংলা বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পারদর্শিতা পুরস্কার চালু করেছিস্ আর সেটা তোরা আবার আমার হাত দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিস, সেজন্যও আমি সম্মানিত তবে সঙ্গত কারণে একটু বিব্রত। আমার মেয়ে সুকন্যা কাজলের ছাত্রী। সে আর আমি তোদের ট্রাস্টকে একটা প্যাকেটে কিছু টাকা দিয়ে গেলাম এটা তোরা এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষাকল্যাণমূলক কাজে খরচ করিস। আজ চললাম, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। দিনের আলো থাকতে থাকতে বাড়ি না ফিরলে সুকন্যা চিন্তা করে। আগে ওর মা করত , এখন সে নেই, তাই আমার সবকিছুর ভার সুকন্যার হাতে।
আমি এসব শুনে ভাবলাম সুকন্যা কত বড় হয়ে গেছে । আমি তাকে ৭-৮ বছরের টেপ জামা পরা অবস্থায় দেখেছি। সে এম এস সি ফার্স্ট ক্লাস বিএড। এখন স্কুলের শিক্ষিকা। নাম যেমন সুকন্যা, কাজেও সুকন্যা। সুকন্যার মঙ্গল হউক – আমার বাংলার শিক্ষক সুধীরবাবু সুস্থ থাকুন ।