হোমPlot1বাংলার শিক্ষায় নৈরাজ্য, অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ

বাংলার শিক্ষায় নৈরাজ্য, অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ

বাংলার শিক্ষায় নৈরাজ্য, অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ

এক জটিল সঙ্কটের আঁধারে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা। আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যেই চাকরি গিয়েছে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীর। ২০১৪ সালে প্রাথমিকে নিযুক্ত ৩২ হাজার শিক্ষকের মামলা এখনও আদালতের বিচারাধীন। ২০১৭ সালের প্রাথমিক টেটের নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রশ্ন ভুল’ সংক্রান্ত মামলাও জট পাকিয়ে রয়েছে। এর মধ্যেই ওবিসি তালিকা নিয়ে মামলার কারণে রাজ্যের কলেজগুলিতে ভর্তি আটকে রয়েছে। ওবিসি জটিলতার কারণে এই বছর এখনও পর্যন্ত প্রকাশ করা যায়নি রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফলও।

রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। তার ওপর এই চারটি সমস্যা এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে। সরকারের অস্বস্তি, বিড়ম্বনার পাশাপাশি যে প্রশ্নটি উঠে আসছে, তা হল, কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল? এর দায় কার? এই বিড়ম্বনার জন্য সরকারের দায় কতটুকু? সরকার কি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছে?

রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তা এককথায় নজিরবিহীন। উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরিয়ে গিয়েছে, অথচ মাসের পর মাস কলেজে ভর্তি হতে পারছেন না, অতীতে কখনও পড়ুয়াদের এই ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয়নি ছাত্রছাত্রীদের। সাধারণত অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে কলেজগুলিতে পঠনপাঠন চালু হয়ে যায়। এ বছর এখনও পর্যন্ত ভর্তিই শুরু করা যায়নি। অথচ মে মাসে ফল প্রকাশিত হয়েছে। 

এ বছর সেপ্টেম্বরেও কলেজগুলিতে ক্লাস শুরু করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সেপ্টেম্বরে ক্লাস চালু করা  হলেও, কিছু দিনের মধ্যেই পুজোর ছুটি শুরু হয়ে যাবে। তাই সঠিকভাবে পড়াশোনা অক্টোবরের আগে শুরুই করা যাবে না। এর ফলে প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত হবে কিংবা তার প্রভাব পড়বে পরের সেমিস্টারে। আরেকটি বিষয় হল, প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশের প্রায় এক মাস বাদে দ্বিতীয় মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়। এই বছর সেই তালিকা প্রকাশ করতে করতে হয়ত পুজো পেরিয়ে যেতে পারে। তাতে পড়ুয়ারা অনেকটাই পিছিয়ে পড়বেন।

সরকার পরিচালিত কলেজে এই অচলাবস্থা তৈরি হলেও, বেসরকারি কলেজগুলিতে অবশ্য ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ওবিসি তালিকা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এই আইনি জটের কারণে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফলাফল প্রকাশ করা যায়নি। অন্যদিকে, সর্বভারতীয় জয়েন্টের ফলপ্রকাশ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের মতো উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন অভিভাবকেরাও।

ওবিসি জটে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন প্রান্তিক মেধাবী পড়ুয়ারা, যাঁদের বেসরকারি কলেজে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ  নেই। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে পড়াশোনার খরচ প্রচুর। আইআইটি-র মতো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও সেমিস্টার পিছু প্রায় এক লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়। অন্যদিকে, যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চার বছরে খরচ লাগে মাত্র ১০ হাজার টাকা। কবে এই জট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তার কোনও সদুত্তর রাজ্য সরকারের কাছে নেই।

কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট। এবারের এই পরিস্থিতি নিয়ে শাসক দলের অন্দরেই চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কারণ, আগামী বছরের বিধানসভার ভোট। তার ওপর নেতামন্ত্রীদের সন্তানরাও এই জটিলতার কারণে স্নাতক স্তরে ভর্তি হতে পারছেন না। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর অনিবার্যভাবেই বল ঠেলে দিয়েছেন আদালতের কোর্টে। যত দ্রুত সম্ভব জটিলতা কাটিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা চার বার তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন ‘সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই’ নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর প্রথম মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন প্রথম বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রী। ২০১১-র ২০ মে থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের স্কুল শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারপর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য।

২০১৪ সালে ব্রাত্যকে সরিয়ে এই দফতরের মন্ত্রী করা হয় পার্থকে। টানা সাত বছর শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।  নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গত তিন বছর ধরে তিনি হাজতবাস করছেন। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় যত অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তার সবটাই হয়েছে পার্থর জমানায়। ২০২১ সালে পার্থকে সরিয়ে আবারও শিক্ষা মন্ত্রী করা হয় ব্রাত্যকে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি, ফাঁকা ওএমআর শিট, প্রার্থীদের তালিকায় গরমিল ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই চূড়ান্ত অনিয়ম ধরা পড়েছে।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি নিয়ে বর্তমান শাসকদলের নেতারা সাফাই দিতে গিয়ে হামেশাই সিপিএমের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তাঁদের এই অভিযোগের সত্যতাও রয়েছে। কিন্তু প্রমাণ করা যাবে না। কারণ, ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত সিপিএম যেভাবে সংগঠিতভাবে শিক্ষক নিয়োগ করেছিল, তৃণমূল তা করতে পারেনি। অর্থাৎ সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয় ছিল, যা তৃণমূলের ক্ষেত্রে হয়নি। তাই তৃণমূলের এই ল্যাজেগোবরে অবস্থা। 

আর সিপিএম আমলে চাকরির জন্য এত ব্যাপকহারে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়নি। সিপিএম যেটা করেছিল, তা হল, নির্লজ্জ স্বজনপোষণ। অর্থাৎ নিয়োগের তালিকা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে দলের নেতাকর্মীদের পরিবারের বাইরে অন্য কারোর নাম না থাকে। তবে কিছু কিছু সাধারণ প্রার্থীর নাম তালিকায় রাখা হত। কথায় বলে, চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি ধরা না পড়ে। সিপিএমের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে, যা তৃণমূল করতে পারেনি। শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মুখেও বারবার শুনেছি, চাকরি দিতে হলে, দলীয় কর্মীদের দেওয়া হবে।

বাম আমলে শিক্ষায় ‘অনিলায়ন’ নিয়ে বারবার নানা অভিযোগ উঠেছে। সিপিএমের তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের হাতেই ছিল পুরো শিক্ষাব্যবস্থার লাগাম। আলিমুদ্দিনে বসেই তিনি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু তৃণমূলের আমলে এই ধরনের কোনও ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

কয়লা, বালি বা গরুপাচারের মতো ইস্যু এই মুহূর্তে পিছনে চলে গিয়েছে। এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতিই তৃণমূলের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরুপাচার মামলায় দীর্ঘ কারাবাসের পর আপাতত জামিনে মুক্ত রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। রে‌শন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়া প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও এখন জামিনে রয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার মতো বেলাগাম চুরি কোথাও দেখা যায়নি।

তৃণমূলের কাছে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল, আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচন। এবার যাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁদের বয়স সবে ১৮-র গণ্ডি পেরিয়েছে। তাই আগামী বছরে শুধু এই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া নয়, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভোটও যদি তৃণমূলের বিরুদ্ধে যায়, তবে শাসক শিবিরের কাছে তা চিন্তার বিষয়। সেইসঙ্গে রয়েছে চাকরিহারা শিক্ষক এবং তাঁদের পরিবারের বড় অংশের ভোটও তৃণমূলের বিপক্ষে গেলে, তা ভোটের ফলাফলে বড় হেরফের ঘটাতে পারে। 

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img