হোমPlot1পঞ্চবটি ও পঞ্চমুণ্ডির সংযোগে শান্তিপুরের জজ পণ্ডিত বাড়িতে পূজিত হন দেবী দুর্গা

পঞ্চবটি ও পঞ্চমুণ্ডির সংযোগে শান্তিপুরের জজ পণ্ডিত বাড়িতে পূজিত হন দেবী দুর্গা

পঞ্চবটি ও পঞ্চমুণ্ডির সংযোগে শান্তিপুরের জজ পণ্ডিত বাড়িতে পূজিত হন দেবী দুর্গা

শিবাণী ভট্টাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ফেলে আসা অতীতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে তন্ত্রসাধনার এক দীর্ঘ ইতিহাস। তাই পঞ্চবটি ও পঞ্চমুণ্ডির সংযোগে নদিয়ার শান্তিপুরের তর্কবাগীশ লেনের জজ পণ্ডিত বাড়িতে দেবী পূজিত হন শাক্ত মতে। দেবীর আরাধনায় এই পুজোর এ এক সমৃদ্ধ বিশেষত্ব।

দেবী এখানে পূজিত হন এক্কেবারে একা। মহিষাসুরমর্দিনী রূপে। রথের দিন এখানে পাটে সিঁদুর দেওয়া হয়। বোধন হয় ঠাকুর বাড়ির একেবারে নিকটবর্তী পঞ্চবটির নির্দিষ্ট আসনে। মায়ের বিরাজ ক্ষেত্রের নিচে অবস্থান করে প্রাচীন পঞ্চমুণ্ডির আসন। এ পুজোয় বাড়ির সদস্যরাই অংশ নেন পৌরোহিত্যে। এটাই এই পরিবারের প্রথা, যা চলে আসছে ৪৫০ বছর ধরে, কারও মতে, ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

গয়ার যদুয়া গ্রামে একসময় বিরাট জমিদারি ছিল এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের। এই পরিবারেরই সুসন্তান পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায় তর্কবাগীশ উপাধি পান। তাঁর জমিদারির সর্বস্তরের প্রজাদের যাবতীয় সমস্যার বিচারের ভার ছিল তাঁরই ওপর। সনাতন ধর্ম ও শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য এই পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায়কে করে তুলেছিল জীবন্ত কিংবদন্তি। প্রজাদের বিচারের দায়িত্ব পালন করা এবং অগাধ পাণ্ডিত্য – এই দুইয়ের কারণেই ‘জজ পণ্ডিত’ হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর সূত্র ধরেই তাঁর শান্তিপুরের বাড়ি হয়ে ওঠে জজ পণ্ডিত বাড়ি। আর বাড়ির অবস্থান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তর্কবাগীশ লেন।

কোনও এক অজ্ঞাত কারণে একসময় শান্তিপুরে চলে আসেন পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায়। শান্তিপুরে এসে তিনি পত্তন করেন নতুন জমিদারির। এখানে এসে তিনি নতুনভাবে শুরু করেন দেবীর আরাধনা। মাতৃ সাধনার জন্য নির্মিত হয় পাঁচখিলান বিশিষ্ট দালান। আজও সেখানেই আয়োজিত হয় মাতৃ বন্দনা।

এই জজ পণ্ডিত বাড়িতে সপ্তমীতে মোচা, কচুর শাকসহ মরশুমি ফসলের ভোগ থাকে।  অষ্টমীতে থাকে সাদাভাত, ইলিশ। নবমীতে অন্যান্য পদের সঙ্গে সঙ্গে দেবীকে দেওয়া হয় চালতার অম্বল। দশমীতে বিদায়ের মুহূর্তে মায়ের জন্য থাকে পান্তা, কচুর শাক আর কাঁচ কলার বড়া।

দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবারের পুজোয় নবমীতে ১০৮ টা মোষ বলি ও ২৮ টা পাঁঠা বলি হলেও বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জমিদারির ঐশ্বর্যকালে দেবীর পুজো হতো বেলজিয়াম ফানুসের আলোয়। এই অপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে ভিড় জমাতেন অসংখ্য মানুষ। তবে পরবর্তীকালে সেই ফানুস চুরি হওয়ার পর ইলেকট্রিক আলো ব্যবহার করা হয় পুজোয়। এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ঐশ্বর্যের দিনে উৎসবের সময় প্রজারা পেতেন নানা রকম উপহার। প্রতিদিন থাকত নরনারায়ণ সেবা। দূর দূরান্ত থেকে আসতেন বহু মানুষ।

এই বাড়ির পুজোতে এক সময় এসেছিলেন অমর কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জজ পণ্ডিত বাড়ির কন্যা নির্মলা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল শোককাব্য ‘অশ্রু’-র কবি ভোলানাথ বন্দোপাধ্যায়ের। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে এ বাড়ির দুর্গাপূজায় এসেছিলেন বিভূতিভূষণ। এ প্রসঙ্গে ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সঠিক সাল তারিখ জানা নেই। তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ বাড়ির পুজোয় এসেছিলেন। দুর্গাপুজোতে, কালী পুজোতেও।”

এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর কথা বলতে গিয়ে জজ পণ্ডিত পরিবারের কন্যা ড. সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জমিদারি আমলের আড়ম্বর আজ আর নেই। তবে ভক্তি, নিষ্ঠা আর ঐতিহ্য আছে। আর সেজন্যই আজও এই বাড়ির মাতৃ আরাধনা এক অন্য রূপ পায়।”

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img