ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
জ্যৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনে পালিত হয় ‘অরণ্যষষ্ঠী’। দিনটিকে জামাইষষ্ঠী, বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী নামেও অভিহিত করা হয়। অরণ্যের সঙ্গে এই দিনটি সম্পৃক্ত, এটি সম্ভবত অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে মানুষের হারানো যোগসূত্রের সাক্ষ্য-বহনকারী একটি পার্বণ। যখন অরণ্য-মাতাই ছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদদার।
মানুষ যে যুগ থেকে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-ভেষজের জন্য নির্ভর অরণ্যের উপর করত, সেই যুগের বন-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব হল অরণ্যষষ্ঠী।
কৃষি সভ্যতার যুগেও ছিল কৃষি-বন (Agroforestry)-এর ধারণা বহাল ছিল। তাই যুগের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যষষ্ঠীর কৃত্য ক্রমে ক্রমে বদলে গেল।
সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক না কেন, অরণ্য ও তার বনস্পতি, তার অপরিমেয় জৈববৈচিত্র আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ।
দেবী ষষ্ঠী সর্বদা সন্তানের মঙ্গলময়ী মাতা। কেবল আপন সন্তান নয়, আপনার কন্যার স্বামীও যে তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয়েছে জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় নারী তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান। তার প্রকাশ ঘটেছে জামাই আদরের প্রেক্ষাপটে। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙ্গা, কী নেই সেই তালিকায়।
এই সুখের দিনে ছেলেমেয়ের ভরা সংসার দেখতে চান হিন্দু নারী, নাতি-নাতনীদের হৈ-হুল্লোড়, গাছে গাছে দাপাদাপি। এরপর তো শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাতায়াত সুখের হবে না, তাছাড়া আমন মরশুমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই।
এদিন ব্রতচারিণী হিন্দু রমণী তালপাতার এক পাখা বা ব্যজন, সঙ্গে দেবীপূজার নানান উপকরণ নিয়ে বনে প্রবেশ করেন। সেখানে বৃক্ষতলে অধিষ্ঠিত বিন্ধ্যবাসিনী অরণ্যষষ্ঠী দেবীকে আন্তরিক ভক্তিশ্রদ্ধায় পুজো করেন, সমবেতভাবে দেবীর উপাখ্যান শোনেন, তারপর নানাবিধ মরশুমি ফলমূল পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বিতরণ করে নিজেরাও গ্রহণ করেন। সন্তানসন্ততির পরম কল্যাণ কামনাই এই ব্রতের মূলকথা। বৃহত্তর অর্থে মনুষ্য সমাজে সবাই যে অরণ্যের সন্তান। কামনা এই — দেবী অরণ্য, তুমি যাবতীয় সম্পদ ভরিয়ে দিয়ে আমাদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলো। অরণ্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে আমরা পরিপুষ্ট হই এবং সুসন্তান লাভ করি।
দেবীর রূপকল্পনা কেমন? দেবী মানবীর মতই দ্বিভূজা, বাম কোলে একটি শিশু, দেবীর বাহন একটি কালো বেড়াল। বাহন কল্পনার মধ্যে ফার্টিলিটি-কাল্ট বা প্রজনন-সংস্কৃতিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। বেড়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে মানুষ সচেতন। এই দিন বেড়ালকে ভালোমন্দ খেতে দেবার মধ্যে জীবসেবার আদর্শকে ব্রতের আঙ্গিকে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে।
ব্রত হল মনস্কামনার স্বরূপ; মানুষের কামনা চরিতার্থতার অন্যতম ক্রিয়াকর্ম। সনাতনী ধর্মের সুলভ সংস্করণ এই ব্রত, হিন্দু রমণীর সমকালীন জীবন্ত বর্ণনা, যে বর্ণনার পরতে পরতে নানা যুগের নানান আঁচড়, যে আবরণ একের পর এক সরালে বেরিয়ে আসে আবহমান ভারতবর্ষের এক শাশ্বত রূপ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “চিনির ডেলার আকারে কুইনাইন পিল।”
ব্রতগুলি সনাতনী হিন্দু ধর্মের বহুজটিল অনুষ্ঠান, দেবদেবীর মাহাত্ম্য, তন্ত্র ও পুরাণকথা প্রচার ও সংযোগ-সামর্থ্যের এক ধারা। এ যেন অনন্য নীতিশিক্ষা আর ধর্ম-সংস্কৃতির এক প্রাথমিক স্কুল, বিদেশি কিণ্ডারগার্টেন প্রণালীর মতোই ভারতীয় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় এক একটি ক্লাসের বই। গৃহ, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, প্রকৃতির প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধের একটি সহজ সরলতা ব্রতের যাবতীয় কৃত্য, চিত্র, পদ্য ও উপাখ্যানের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে।
পণ্ডিত মানুষদের বক্তব্য হচ্ছে, ঋতু ও বিশ্বপ্রকৃতির পট পরিবর্তনের সঙ্গে উদ্ভূত জীবনের নানান বিপর্যয়কে ঠেকাবার অদম্য ইচ্ছে থেকেই ব্রতের উৎপত্তি।
কীভাবে হয় অরণ্যষষ্ঠীর পূজা? ব্রতের শ্রেণিবিভাগের দিক থেকে একে অধুনা শাস্ত্রীয় ব্রত বলা হলেও তারমধ্যে লৌকিক ধারাটিও লুকিয়ে আছে। এটি নারীব্রত; বিবাহিত মেয়েরা এই ব্রত পালন করলেও কুমারী মেয়েরা মায়ের সঙ্গে গিয়ে বিবাহের আগে থেকেই পরিচিতি লাভ করে। অরণ্যষষ্ঠীকে শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় উভয় অনুষ্ঠানের যুগলমূর্তি বলা যেতে পারে। শাস্ত্রীয় এ কারণেই — এই ব্রতের আঙ্গিকে বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা — আচমন, স্বস্তিবাচন, ‘সূর্যঃ সোমো’ মন্ত্রপাঠ, কর্মারম্ভ সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, আসনশুদ্ধি, ভূতশুদ্ধি, মাতৃকান্যাস, বিশেষার্ঘ্য স্থাপন, গণেশ ইত্যাদি দেবতার পূজা, অঙ্গন্যাস, করন্যাস, ষষ্ঠীর ধ্যান করে তাঁর পূজা, পূজান্তে ব্রাহ্মণকে দান-দক্ষিণা ইত্যাদি।
অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতকথার মূল বিষয় হল, মা এবং পরিবার যে মানুষের কাছে স্বর্গসুখের চাইতে অধিক কাম্য, তার প্রকাশ। জননীকে হতে হয় সংযমশীলা, নির্লোভা, ভক্তিপরায়ণা — তাও দেখানো হয়েছে ব্রতকথায়।
এক গৃহস্থ রমণী লোভের বশবর্তী হয়ে নিত্যদিন ভাঁড়ারের নানান খাদ্যবস্তু চুরি করে খেতো, প্রশ্ন উঠলে বিড়ালের নামে অপবাদ দিত এবং এইভাবে ভোজনলালসার পর আত্মরক্ষা করতো। এদিকে বিড়াল দেবী ষষ্ঠীর বাহন। তাই দেবীর কোপে পড়ে সেই রমণীর একাদিক্রমে ছয় পুত্র জন্মানোর অব্যবহিত পরেই মৃত্যু মুখে পতিত হল৷ এই ছয় পুত্র ছিল প্রকৃতপক্ষে শাপভ্রষ্ট বিদ্যাধর। ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শ্বশুরবাড়িতে এবং সমাজে রমণীর প্রবল বদনাম হল। তারা তাকে সন্তানভোজী রাক্ষসী ঠাওর করলো৷ বুঝি নিজের সন্তান নিজেই ধরে খায় বধূটি! আত্মগ্লানিতে ওই রমণী গৃহ পরিত্যাগ করে বনে চলে গেল।
এদিকে গৃহে তার শাশুড়ী-মা ষষ্ঠীর আরাধনায় রত হলেন। বনে জন্ম নিলো বধূর সপ্তম সন্তান। নবজাতক তার মা-কে জড়িয়ে ধরে বললে, মা কিংবা বোনকে ছেড়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন নয়, যতই স্বর্গের ভোগ ও সুখ ডাক দিক না কেন! নবজাতক সেই ডাকে সাড়া দিলো না। মায়ের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডাকলো সেই সন্তান। সন্তানকে কোলে জড়িয়ে মা কেঁদে ফেললো; দেবী ষষ্ঠীকে একমনে ডাকতেও লাগলো।
করুণাময়ী দেবীর সেই থান, দেবী আবির্ভূতা হলেন অনতিবিলম্বে; বললেন, বিড়ালের নামে অপবাদ দেওয়ার অপরাধে তিনি তার সকল সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছেন, তার প্রতিটি সন্তানই দেবতুল্য। বধূ দেবীর চরণ প্রার্থনা করলে, তিনি এক মরা পচা বিড়ালের উপর দই ফেলে জিভ দিয়ে চেটে তা তুলে আনতে নির্দেশ দিলেন। বধূ সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে, দেবীর কৃপায় বিড়াল সহ হারানো ছয়পুত্র ফিরে পেলো। সবাহন দেবীকে পুজো করে, সে সপুত্র গৃহে ফিরে এলে গৃহস্থ পরিবারে খুশির ঢল নামলো।