সাদা চুল, ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে সিগারেট। রাইটার্স থেকে নন্দন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা বললে এই ছবিটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাজনীতির জগতের মানুষ হলেও, অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরা পড়ে। এমনকি সিপিএম নেতাদের চেয়েও তিনি যেন একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব। পরনের পোশাক থেকে পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট, সবটাই অত্যন্ত ছিমছাম, সাদামাটা।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বহুবার তাঁর বাসভবন বদলের কথা হয়েছে। কিন্তু রাজি করানো যায়নি বুদ্ধদেবকে। পায়ে চামড়ার কালো স্যান্ডেল, হাতে কালো চামড়ার বেল্ট, ছোট গোল ডায়ালের ঘড়ি এবং চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা।
১৯৬৬ সালেই সিপিএমে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৮-র জুন মাসে যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই তৈরির পর তাঁকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭১-এ সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য হন তিনি। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতার কাশিপুর কেন্দ্র থেকে প্রথমবার প্রার্থী হয়েই বিধায়ক নির্বাচিত হন। সাতাত্তরে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভাতেই তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬-এ তাঁকে স্বরাষ্ট্র দফতরেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়।নি
১৯৮২ সালের নির্বাচনে, কাশিপুর আসনে কংগ্রেসের প্রফুল্লকান্তি ঘোষের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। পাঁচ বছর পর যাদবপুর থেকে জিতে আবার মন্ত্রিসভায় ফিরেছিলেন। এরপর থেকে পাকাপাকিভাবে যাদবপুরই তাঁর পাকাপাকি বিধানসভা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
১৯৯৯ সালে তাঁকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ২০০০ সালে জ্যোতি বসু দায়িত্ব ছাড়ার পর, তিনিই হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০০১ এবং ২০০৬ সালে দলকে বড় জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০১-এ রাজ্যের ২৯৪ আসনের মধ্যে বামেরা জিতেছিল ১৯৯ আসনে। আর ২০০৬ সালে বামেরা পেয়েছিল ২৩৫টি আসন।
১৯৮৪ সালে তাঁকে সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়। পরের বছরই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। ২০০২ সালে সিপিআইএম-এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণকারী কমিটি, পলিটব্যুরোর সদস্যপদ দেওয়া হয় তাঁকে।
১৯৯৩ সালে তথ্য ও সংস্কৃতি, পুর ও এবং নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী থাকাকালীন আচমকা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। ‘চলছে না, চলবে না’ – এই সংস্কৃতি বদলে রাজ্যের ভাবমূর্তির পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন তিনি।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বরাবর বাঙা়লি খাবার খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর সবসময়ের সঙ্গী ছিল চা, কফি। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব ছাত্র রাজনীতির সময়কাল থেকেই ধূমপান করতেন। পরবর্তীকালে দামি একটি বিশেষ ব্র্যান্ডেরই সিগারেট খেতেন তিনি। তাঁর জীবনে বিলাসিতা বলতে ছিল এটুকুই।
রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও ছিল অবাধ বিচরণ। সাহিত্যিক, নাট্যকার, লেখক এবং আবৃত্তিকার। মন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিত নাটক লেখা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কাজের চাপ না থাকলে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে নন্দনে যেতেন। সেখানে তাঁকে ঘিরে থাকতেন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনেরা।