ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
অন্নদামঙ্গল কাব্যে সর্পবৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, “কেউটে খরিশ কালী গোখুরা ময়াল। বোড়া চিতি শঙ্খচূড় সূঁচে ব্রহ্মজাল।।
শাঁখিনী চামর কোষা সূতার সঞ্চার।
খঁড়ীচোঁচ অজগর বিষের ভান্ডার।
তক্ষক উদয়কাল ডারাশ কানাড়া।
লাউডগা কাউশর কুয়ে বেতাছাড়া।
ছাতাড়ে শীয়রচাঁদা নানাজাতি বোড়া
ঢেমনা মোটিলী পুঁয়ে হেলে চিতী ঢোঁড়া।
বিছা বিছুপিঁপিড়া প্রভৃতি বিষধর।
সৃষ্টিহেতু জোড়ে জোড়ে গড়িল বিস্তর।।”
এখানে কোবরা গ্রুপের কেউটে (Indian Cobra), খরিশ/গোখরো (Common Cobra), শঙ্খচূড় (King Cobra) সাপের মত বিষধর সাপের নাম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বিষধর শাঁখিনী (Banded Krait), শীয়রচাঁদা (কালো কালাচ Black Krait), বোড়া (চন্দ্র বোড়া Russell’s Viper)-র মত তীব্র বিষধর সাপের কথাও রয়েছে।
ময়াল (Rock Python), অজগর (Common Python), বোড়া চিতি (Wolf Snake), ডাড়াশ (Rat Snake), কানাড়া বা কাঁড় (Common Cat Snake), লাউডগা (Whip/Vine Snake), বেতাছাড়া (Bronze Back Snake), মেটিলি, পুয়ে (Common Blind Snake), হেলে (Stipped Keelback), ঢোঁড়ার (Checkered Keelback) নির্বিষ এবং সামান্য বিষধর নানান সাপেরও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
সাপের দেবী মনসা। দেবী মনসার মূর্তি ভাবনার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট ক্রমবিকাশ দেখা যায়। আদিতে সাপ নামক প্রাণীটিই পূজিত হত। তারপর এলো সাপের অবয়বে সর্পচালি রেখে পূজা। এটাই হল জুমর্ফিক ফর্ম। আজকের মনুষ্য-মূর্তির মনসা বা অ্যান্থেরোমর্ফিক দেবীর সৃষ্টি অনেক পরে। এর মাঝে যে মূর্তি ভাবনা পাওয়া যায়, তাতে রয়েছে সাপের অবয়ব আর মনুষ্য অবয়বের মিশেল। যে মনসা-ঘটে বা মনসা-চালায় দেবী আবক্ষ মানবী-রূপী, আর নিম্নে সর্পের মত দেহ, তাকে বলা হয় থেরিওমর্ফিক মূর্তি।
সাপ এক ভয়ঙ্কর-সুন্দর প্রাণী। লোককবি সাপের সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন বলেই মনসামঙ্গল কাব্যে দেখা যায়। দেবী নানান সাপে সজ্জিতা। কোনো সাপ তার গলার হার, কোনো সাপ কাঁচুলি, কোনোটি হাতের বালা। এই নান্দনিকতা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। সাপ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র লভ্য, লভ্য কৃষিবাস্তুতন্ত্রে। বাংলার জমি-জিরেতে, জলে-জঙ্গলে সাপের অহরহ আনাগোনা ছিল; ছিল সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা। ভয়ে-ভক্তিতে মানুষ সাপকে পুজো করতে শুরু করলো। শুরু হল মানুষের সর্প-চারণা। দেবী মনসা হলেন বাঙালি হিন্দুর সর্প-চারণার এক চরম আধ্যাত্মিকতা, নান্দনিক দার্শনিকতা।
ভারতীয় ডাকবিভাগ ২০০৩ সালে চারটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে সাপের ছবি দিয়ে, কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে এই সাপ ভারতের কোনো না কোনো অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই চারটি সাপ হল বিষধর King Cobra বা শঙ্খচূড়, বিষধর Bamboo Pit Viper বা বাঁশ-বোড়া, ক্ষীণ-বিষ Gliding Sanke বা কালনাগিনী এবং নির্বিষ অথচ ভয়ঙ্কর Python বা অজগর।