ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় বারবার ফিরে এসেছে হরিণ প্রসঙ্গ। ক্ষণিকা কাব্যের কৃষ্ণকলি কবিতায় রয়েছে কালো হরিণ চোখের বর্ণনা। ভারতবর্ষ, সমবায় নীতি প্রবন্ধ, চিরকুমার সভা বা প্রজাপতির নির্বন্ধ নাটকে একচক্ষু হরিণের উপমা দেখতে পাই। দালিয়া, পলাতকা কিম্বা চোখের বালিতে পাই পোষা হরিণের কথা আর কবি কাহিণী, রাজর্ষী, কালমৃগয়া, চিত্রাঙ্গদা, শিশু, শিশু ভোলানাথ, ছবি ও গান, সহজ পাঠে আছে বনের হরিণের কথা। বনফুল, শব্দতত্ত, নদী, ভানুসিংহের পদাবলী ইত্যাদিতে ছড়িয়ে আছে হরিণের নানা উপমা । রবীন্দ্রনাথের অনেক গানেও হরিণের সন্ধান পাওয়া যায়। আর বাল্মীকিপ্রতিভা নাটকের হরিণের কথা তো সবাই জানেন। এগুলি সবই নেহাত গল্পের কিম্বা আলোচনার খাতিরেই লেখা। কিন্তু রাজা নাটকে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি চেয়ে বসলেন একটা গোটা হরিণ। যে সে হরিণ নয়, একেবারে সোনার হরিণ।
তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।
মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই।।
সে-যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।
সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।
আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই—
আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই।।
তোরা পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে—
যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।
আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে—
আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি তারি শোকে?
আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।
আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই।।
সে হরিণ চঞ্চল, মাঠঘাট পেরিয়ে সে ছুটে বেড়ায় আপনমনে। জানি তাকে ধরা যাবে না, কিন্তু শেষ পুঁজিটুকে খরচ করেও মানুষ তার পিছনে ধাওয়া করে মিথ্যে আশায়। আধুনিক জীবনের লুব্ধ চিত্তের স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাই সোনার হরিণের প্রতীক হিসাবে ধরা দিয়েছে এই গানে। যা আছে তাতে খুশী না হয়ে আমরা ছুটে বেড়াই যা-নেই, যাকে পাওয়া যায় না, তারই পিছনে। যুগ যুগ ধরেই মানুষের অতৃপ্ত বাসনা খুঁজে বেড়ায় সেই অধরাকে অলিক মরীচিকায়।
১৯১৮ সাল। দিনেন্দ্রনাথ তখন সস্ত্রীক কমলাদেবীকে নিয়ে বাস করছেন শান্তিনিকেতনের দ্বারিক ভবনে। তাঁদের একটা পোষা হরিণ ছিল। সে ছিল সকলের আদরের। দ্বারিকের পশ্চিমদিকের শরীষ গাছের নীচের বাগানে সে সারাদিন খেলে বেড়াত। একদিন বিকাল থেকে ছোট্টো হরিণটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্ভবত বাগানের বাইরে বেরিয়ে সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। আশেপাশের সব জায়গায় অনেক খুঁজেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। প্রাণপ্রিয় হরিণশিশুকে হারিয়ে কমলাদেবী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। পরে জানা গেল দূরে সাঁওতাল পড়ার লোকেদের হাতে সে ধরা পড়েছে আর হরিণটাকে তারা মেরেও ফেলেছে। হরিণটাকে রবীন্দ্রনাথও ভালোবেসে ছিলেন। ঐদিনই তিনি রচনা করলেন একটি গান।
সে কোন্ বনের হরিণ ছিল আমার মনে। কে তারে বাঁধল অকারণে।
গতিরাগের সে ছিল গান, আলোছায়ার সে ছিল প্রাণ, আকাশকে সে চমকে দিত বনে।
মেঘলা দিনের আকুলতা বাজিয়ে যেত পায়ে তমাল ছায়ে-ছায়ে।
ফাল্গুনে সে পিয়ালতলায় কে জানিত কোথায় পলায় দখিন-হাওয়ার চঞ্চলতার সনে।
সেই সময়ে, কন্যা বেলা দেবীর মৃত্যুর (১৬ মে ১৯১৮) পরে, রবীন্দ্রনাথ গভীর বেদনাভরা পলাতকার কবিতাগুলি রচনা করছেন। সেই আবহেই, নিজেদের পোষা হরিণ হারিয়ে যাওয়ার ছবিটি ফুটে উঠেছে পলাতকা কাব্যের ‘নিরুদ্দেশ’ কবিতায়
ঐ যেখানে শিরীষ গাছে
ঝুরু-ঝুরু কচি পাতার নাচে
ঘাসের ’পরে ছায়াখানি কাঁপায় থরথর
ঝরা ফুলের গন্ধে ভরভর –
ঐখানে মোর পোষা হরিণ চরত আপন মনে
হেনা-বেড়ার কোণে
শীতের রোদে সারা সকালবেলা।
তারি সঙ্গে করত খেলা
পাহাড়-থেকে-আনা
ঘন রাঙা রোঁয়ায় ঢাকা একটি কুকুরছানা।
মানুষ ভালোবাসে আর প্রিয় জিনিসটিকে। সে হতে পারে স্বজন, বন্ধু, পোষা জীব বা কোনো জড়বস্তু। সে যতক্ষণ আমাদের জাগতিক বা মানসিক পরিধির ভিতর থাকে ততক্ষণ আমরা নিশ্চিন্ত থাকি, তার উপস্থিতি আমাদের মনকে শান্ত রাখে। কিন্তু যখনই সে আমাদের অধিকারের বাইরে চলে যায়, যখন তাকে আর চাইলেও পাওয়া যায় না, তখন তাকে হারানোর বেদনা আমাদের আকুল করে তোলে। তার নানা ঘটনা নিয়ত আমাদের স্মৃতিতে আলোড়ন তোলে। কিন্তু সে স্মৃতিবেদনাও কালের প্রবাহে একদিন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে। আসলে যা হারিয়ে যায় তাকে নিয়ে আমরা চিরকাল আগলে বসে থাকি না। থাকা সম্ভব না। এটাই বোধহয় জীবনদেবতার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ৭৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন শ্যামা নৃত্যনাট্য। উত্তীয়-র মাধ্যমে জানালেন শাশ্বত বার্তা।
মায়াবন বিহারিনী হরিণী, গহনস্বপনসঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ।
থাক্ থাক্ নিজ-মনে দূরেতে, আমি শুধু বাঁশরির সুরে তে
পরশ করিব ওর প্রাণমন অকারণ।
চমকিবে ফাগুনের পবনে, পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে,
চিত্ত আকুল হবে, অনুখন অকারণ।
দূর হ’তে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব –
বাঁধনবিহীন সেই যে বাঁধন অকারণ।।
তাই বৃথাই সোনার হরিণের পিছনে ধাওয়া করে তাকে ধরবার চেষ্টা। জীবনে এর ফলাফল কেবলমাত্র শুন্য। এ শুধু অতৃপ্তি আর বেদনায় মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। সে নাগালের বাইরে গিয়ে আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বরং আমাদের যেটুকু আছে তাতেই খুশি থেকে অধরা সৌন্দর্যকে ভালোবেসে প্রাণভরে উপভোগ করাই জীবনকে পূর্ণ করে তোলে।