হোমPlot1দে মল্লিক থেকে বাগবাজার হালদার পরিবার, কলকাতার তিন সিংহবাহিনীর আত্মকথা

দে মল্লিক থেকে বাগবাজার হালদার পরিবার, কলকাতার তিন সিংহবাহিনীর আত্মকথা

দে মল্লিক থেকে বাগবাজার হালদার পরিবার, কলকাতার তিন সিংহবাহিনীর আত্মকথা

শুভদীপ রায় চৌধুরী
কলকাতায় তিন প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনী রয়েছে, যাঁরা সারা বছর পুজো পেলেও শারদীয়ার সময় একটু বেশিই জাঁকজমকভাবে পুজো হয় তাঁদের। দে মল্লিক বংশের সিংহবাহিনীর পাশাপাশি উত্তর কলকাতার চিৎপুর ও বাগবাজারে দুই সিংহবাহিনী রয়েছে।

দে মল্লিক পরিবার
প্রাচীন ভারতবর্ষে সনাতনী হিন্দুধর্মে তন্ত্রের ধারাই প্রবল ছিল। তারপর বৌদ্ধধর্মের জোয়ারে ভারতবর্ষ হিন্দু ধর্মের শক্তি ধারার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মে তন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটে। এই সময়েই দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপকল্পনার সূচনা। দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তিকে বর্তমানে পুজো করা হয়, প্রাচীনকালে তা ছিল কিছুটা অন্যরকম। তবে সেই আদি সিংহবাহিনীর মূর্তি আজও দেখা যায় কলকাতার মল্লিক বাড়িতে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত বংশের পতনের পর  আর্যাবর্ত জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন নানান প্রাদেশিক শাসক। তাঁর মধ্যে অন্যতম পুষ্যভূতি বংশের প্রভাকরবর্ধন এবং তাঁর দুই সন্তান রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন। সিংহবাহিনী পুজো পেতেন পুষ্যভূতিদের কুলদেবী হিসেবে। পরবর্তীকালে এই বংশের পতন হলে, দেবী মূর্তিটি জয়পুরের রাজা মানসিংহের কাজে যায়। তিনি তাঁকে কুলদেবী হিসেবে আরাধনা করতেন। কিন্তু মুঘল আক্রমণের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে রাজপুরোহিত দেবীকে নিয়ে বহুদূরে চলে যান। পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখলেন দেবীকে। সেখান থেকে মাকে উদ্ধার করে আনলেন বৈদ্যনাথ দে মল্লিক। বৈদ্যনাথ বাবু স্বপ্নাদেশ দেখলেন সমুদ্রের ধারে এক পাথুরে গুহায় পড়ে রয়েছেন মা সিংহবাহিনী। দেবী তাঁকে আদেশ করলেন উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। শুধু তাই নয়, দেবী স্বপ্নে সমস্ত পথনির্দেশও দেন তাঁকে।

মানসিংহের পুরোহিতের নির্দেশানুযায়ী, বৈদ্যনাথ দে মল্লিক সিংহবাহিনী পুজোর যে প্রথার প্রচলন করেছিলেন, আজও তা যথারীতি পালিত হয়। দুর্গা, জগদ্ধাত্রী ও বাসন্তীপূজা, বছরে এই তিনবার দেবীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিতের কথামতো মাকে রাত্রের শীতলভোগে মুড়কি দেওয়া হয়। পণ্ডিতের নির্দেশ ছিল প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এবং দুর্গাপুজোয় ছাগবলি দিতে হবে। সেইমতো বলিদান প্রথা চলে এলেও, একবার মল্লিকদের গুরুদেব বলিদানে বাধা দেন। পরে দ্বিধাগ্রস্ত পূজা কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে সিদ্ধান্ত জানতে এসে দেখেন, গুরুদেব রক্তবমি করেছেন। এই ঘটনার পর শনি মঙ্গলবারে বলি বন্ধ করে পরিবর্তে মিষ্টান্ন ভোগ দেওয়া শুরু হয়। তবে শারদীয়ায় বলিদান আগের মতনই চলতে থাকে। সেই থেকে আজও পর্যন্ত দুর্গাপূজায় ৪টি কৃষ্ণবর্ণ-ছাগ বলি দেওয়া হয়। কিন্তু এঁদের নিজকুল প্রথায় হাঁড়িকাঠ ব্যবহার করা হয় না। বালির ওপরে ছাগটিকে স্থাপন করে বলি দেওয়া হয়। 

দুর্গাপুজোর সময় কোনও দুর্গাপ্রতিমা আনা হয় না। অষ্টমী ও নবমীর পুজো একসঙ্গে করা হয়। বাসন্তী পূজাও হয় চৈত্র মাসের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে। তাছাড়া এই পুজোর সময় বাড়ির পুরুষ সদস্যরা নতুন জোড় পরেন এবং বাড়ির মহিলারা প্রাচীন গয়নায় সজ্জিত হন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব সিংহবাহিনীর  সামনেই ভাব সমাধিস্থ হয়েছিলেন। অর্থাভাবে ক্লিষ্ট কোনও মল্লিকদের বাড়িতে পরমারাধ্যা দেবীর দিব্যদর্শন পেয়ে বলেন, “এক পোড়া বাড়িতেও দেখলুম যে, সেখানেও সিংহবাহিনীর মুখের ভাব জ্বলজ্বল করছে।” একবার জনৈক রামগোপাল মল্লিক নামক পালাদারের দুই পুত্র সিংহবাহিনীর বলিদানের বিরোধিতা করেন। রামগোপাল রাজি না হওয়ায় পুজোর সময় তাঁরা বাড়ি পরিত্যাগ করে। সেই নবমীর রাত তাঁরা বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এছাড়াও একসময় সিংহবাহিনীর বিগ্রহ চুরি করার উদ্দ্যেশ্যে কোনও পূজারী ব্রাহ্মণ দেবীর শয়নঘরে প্রবেশ করেন এবং দেবী সেই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে এমন জ্যোতি বিস্ফোরণ করেন যে পূজারির দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। এমনই নানা কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে মা সিংহবাহিনীকে ঘিরে।

গত ৪০০ বছর ধরে মল্লিকবাড়ির বিভিন্ন শাখায় দেবী চক্রাকারে পূজা পেয়ে আসছেন।  মূলত জগদ্ধাত্রীর রূপে তাঁর মূর্তি তৈরি হলেও, বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। যেমন মা সিংহবাহিনী সিংহপৃষ্ঠাসীনা নন, তিনি সিংহের পিঠে দণ্ডায়মানা। বাহন সিংহটি দেবীর ডান দিকে না থেকে রয়েছে বাম দিকে। সিংহের মুখটি অশ্বমুখী এবং সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড। শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব, হিন্দুধর্মের এই তিন ধারার মেলবন্ধন দেখা যায় দেবী বিগ্রহেও। যেমন সিংহটি অশ্বমুখী, শৈব ধর্মের প্রতীক হিসাবে দেবীর সাথে সাথে দুই শিবলিঙ্গ (বাণেশ্বর ও বিশ্বেশ্বর) দেবীর সঙ্গে পূজা পেয়ে আসছেন। রাজ্যবর্ধনের সময় থেকেই দেবী সিংহবাহিনী সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক হিসাবেই পরিচিত।

বাগবাজার হালদার পরিবার: বাংলায় কোথায় প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল, তার সঠিক উত্তর পাওয়া মুশকিল। কিন্তু  ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেমন মিথিলা, বাংলা এবং কামরূপে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করেই আজও পূজা করা হয়। বাংলার ক্ষেত্রে দশভুজা সপরিবার দুর্গার আরাধনাই বেশি হলেও প্রাচীন কালে দেবীর মহিষমর্দিনী চণ্ডীমূর্তিরই পূজা হত। চিত্তেশ্বরী দুর্গামন্দিরে দেবীর নিমকাঠের বিগ্রহের পাশাপাশি উত্তর কলকাতার বাগবাজারে হালদার বংশে আজও প্রতিষ্ঠিত মহিষমর্দিনীর পূজা হয়ে আসছে যা বহুবছরের প্রাচীন।

ষোড়শ শতকে হালদার বংশের আদি বাসস্থান ছিল বঙ্গদেশে হুগলির চন্দননগরে। এই অঞ্চলের ন পাড়ার জমিদার তথা এই বংশের সন্তান কৃষ্ণপ্রসাদ হালদার একসময় ওড়িশার বালেশ্বরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। আর বালেশ্বরের সাহেবপুরে  থাকাকালীন তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, আর সেই মতন তিনি উদ্ধার করেছিলেন পাল সাম্রাজ্যে নির্মিত কষ্টিপাথরের মহিষমর্দিনী শ্রীদুর্গাকে। দেবীর নির্দেশ মতন কৃষ্ণপ্রসাদ এক মুসলিম জেলের বাড়ি থেকে (আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ) উদ্ধার করেন দশভুজাকে। সেই ১৪ ফুট মাটির নীচ থেকে বিগ্রহটির সেবাপূজা শুরু করেন হালদার বংশের সদস্যরা, সেই ধারা আজও বহাল রয়েছে।

মূর্তিটির গঠনশৈলী দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটি পাল রাজত্বে নির্মিত। সে যুগের বিভিন্ন সাহিত্যগত উপাদান থেকে জানা গেছে,  এই রাজত্বেই কষ্টিপাথরের নানান বিগ্রহ নির্মিত হত। সে যুগে যেমন মহিষমর্দিনী চণ্ডীমূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়, তেমনই মহীপাল নির্মিত দুর্গা মন্দিরের উল্লেখও পাওয়া যায়। তাই হালদার বংশের প্রাচীন মূর্তিটি যে ৯৫০-১০০০ বছরেরও প্রাচীন, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া ব্রিটিশ মিউজিয়াম, চন্দননগর মিউজিয়াম কিংবা কলকাতা মিউজিয়ামেও অবিকল একই মূর্তি সংরক্ষিত হলেও, এই পরিবারের মূর্তিটির মতন ওগুলি এতটা নিঁখুত নয়। ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী, আজ থেকে ৫০০ বছর আগে উগ্র শাসকদের হাত থেকে দেব বিগ্রহগুলিকে সুরক্ষিত রাখতে হিন্দু প্রজারা মাটির নীচে পুঁতে রাখতেন।

এই বংশের মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি এতটাই নিঁখুত যে, এই বিগ্রহের বাম হাতের আঙুলে সেই সময়কার একটি আংটি সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়। দেবী এখানে পদ্মের আসনে দাঁড়িয়ে অসুরদলন করছেন, আর তাঁর দুইপাশে দুই সখী, জয়া ও বিজয়া। আর বিগ্রহের মাথার ওপর স্বয়ং মহাকাল বসে রয়েছেন। মূর্তিটির উচ্চতা দুই ফুটের কিছু বেশি এবং ওজন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি। সম্ভবত গোটা বিশ্বে শুধুমাত্র মহিষমর্দিনীর এই  বাড়িতে আছে।

কৃষ্ণপ্রসাদ হালদারের পর এই বংশের প্রাণপুরুষ ছিলেন জমিদার প্রাণকৃষ্ণ হালদার। ১৮১০ সালে ওলন্দাজদের শাসনকালে ‘হুগলীর মহসীন কলেজের’ ভবনটি তাঁদের থেকে কিনে সেটিকে বৈঠকখানা হিসাবে ব্যবহার করতেন জমিদার প্রাণকৃষ্ণ হালদার। এই বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বিরাট অংশ যা বর্তমানে মাদ্রাসার ছাত্রদের বসবাসের স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা ছিল জমিদার প্রাণকৃষ্ণের পাঁচ খিলান বিশিষ্ট বিরাট দুর্গাদালান আর সেই দালানেই তৎকালীন সময়ে পূজিত হতেন হালদারবাড়ির মহিষমর্দিনী। ওলন্দাজরা তাঁর এই বিরাট প্রাসাদের সামনে ছয়জন সিপাহি রাখার অনুমতি দেন। জমিদার প্রাণকৃষ্ণের প্রাসাদ পরবর্তীকালে চুঁচুড়ার জগমোহন শীল কেনেন এবং ১৮৩৬ সালে ২০,০০০ টাকা দিয়ে সেই প্রাসাদটি হুগলীর মহসীন কলেজের জন্য কেনা হয়। এছাড়া ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রাণকৃষ্ণ ১৩০০০ টাকা দিয়ে ত্রিবেণীতে সরস্বতী নদীর ওপর দিয়ে যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটি সেতু নির্মাণ করে দেন। তৎকালীন সময়ে জমিদার প্রাণকৃষ্ণের মতন দানশীল ব্যক্তি এই অঞ্চলে কেউই ছিলেন না।

জমিদার প্রাণকৃষ্ণের পরেই এই বংশের সুসন্তান বাবু নীলমণি হালদার এবং বহুভাষাবিদ নীলরত্ন হালদারের নাম পাওয়া যায়। কলকাতার রানী রাসমণি থেকে শুরু করে তৎকালীন সময়ের বহু গুণিজনের কাছে বাবু নীলমণি হালদার পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। আর তাঁর পুত্র নীলরত্ন হালদারও খুব অল্প বয়সেই ২২টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং কলকাতা থেকেই ‘বঙ্গদূত’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করতেন এবং ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৯মে এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। বলাবাহুল্য, তাঁরই সম্পাদনায় ‘বঙ্গদূত’ বাংলা, ইংরাজি, ফার্সী এবং হিন্দি এই চারটি ভাষায় সম্পাদিত হত। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিদেশ যাত্রার পর বাবু নীলরতন হালদারই বাংলার স্টল বোর্ড দেওয়ান হিসাবে রয়ে গেলেন।

নীলরত্ন হালদারের বৈমাত্রেয় ভাই ধর্মদাস হালদারের প্রচেষ্টায় তৎকালীন সময় অভিনীত হত অগ্রনী বাবু কালচারের থিয়েটার। নাট্যকার গিরিশ ঘোষেরও প্রিয় পাত্র ছিলেন ধর্মদাস হালদার। আর ধর্মদাস হালদারের পরই এই বংশে জন্মগ্রহণ করলেন রাখালদাস হালদার। যিনি যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের ৫২ জন গৃহীভক্তের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তৎকালীন সময় তিনি থাকতেন কলকাতার বৌবাজারের হালদার বাড়িতে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম চিকিৎসকের মধ্যে তিনি একজন। রাখালদাস হালদার মাঝেমধ্যেই কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে আসতেন এবং ঠাকুরও নানান উপদেশ দিয়ে  তাঁকে কৃপা করেছিলেন।

দেবীর বোধনের দিন রেড়ির তেলে যে ‘জাগ প্রদীপ’ জ্বালানো হয় তা বিসর্জন পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও নেভানো হয় না। হালদার বাড়ির কষ্ঠিপাথরের দুর্গা অত্যন্ত জাগ্রত বলে মনে করেন সবাই। তাই তাঁরা বিশ্বাস করেন জাগ প্রদীপ নিভে যাওয়া অশুভ। একবার পূজার সময় প্রচণ্ড ক্লান্তিতে রাত ২টোর পর বাড়ির কেউই প্রদীপটি দেখতে যেতে পারেননি। আর ভোট পাঁচটা হতেই দেখা গেল অদ্ভুতদৃশ্য। যে তাকের নীচে জাগপ্রদীপটি রাখা হয় সেটি কাঠের, কোন কারণে তাকটি ভেঙে পড়ে যায় কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে জাগপ্রদীপের ওপর ভেঙে পড়া দুটি কাঠ মুখোমুখি কাত হয়ে যেন প্রদীপটিকেই সুরক্ষিত করছে আর জাগপ্রদীপটিও একদম ঠিকঠাক ভাবে জ্বলছে। আর প্রতিবারই পুজো সমাপ্ত হয়ে গেলে এই প্রদীপে আর তেল দেওয়া হয় না, আস্তে আস্তে নিভে যায় প্রদীপ। কিন্তু কখনওই নিজে থেকে বাড়ির সদস্যরা প্রদীপ নেভান না।

অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোয় যে ১০৮ প্রদীপ দেওয়া হয় সেটি কখনও ত্রিশূল, কখনও প্রজাপতি, কখনও দেবীর ত্রিনয়ন বা আবার কল্পতরু গাছের মত চেহারা দেওয়া হয় এবং সেটি দেবীর আদেশেই তৈরি হয় হালদারদের ঠাকুরদালানে। এই প্রদীপগুলিকে কলাপাতার উপর রাখা হয়, তারপর সেগুলি জুড়ে দেওয়া হয় পরস্পরের সঙ্গে। তবে সন্ধিপুজোর কোনও কাজ মহিলারা করতে পারেন না। এই কাজ করতে হয় পুরুষদেরই। কাটা ফল নয়, সন্ধিপুজোর সময় বড় বড় আস্ত ফলের সঙ্গে ক্ষীরের ছাপা ও ক্ষীরের চন্দ্রপুলি ভোগ দিতে হয় দেবীর উদ্দেশ্যে।

চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী দুর্গামন্দির: তিলোত্তমার বুকেই রয়েছে এমন কিছু দুর্গামন্দির যাদের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং আজও সে সব মন্দিরে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। তেমনই এক প্রাচীন মন্দির হল চিৎপুরের শ্রীচিত্তেশ্বরী দুর্গামন্দির। জনশ্রুতি অনুযায়ী চিৎপুর অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দেবীচিত্তেশ্বরী দুর্গা। কলকাতা-সহ গোটা বঙ্গে এক ঐতিহাসিক স্থান এই চিৎপুর। চিৎপুর বা প্রাচীন চিত্রপুর গ্রামে ‘চিতে’ বা ‘চিত্তেশ্বর’ নামে এক ডাকাত থাকত। এই দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাত এককালে একটি নিমগাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করে দেবীপ্রতিমা। সেই প্রতিমাই চিত্তেশ্বরী দুর্গা নামে পরিচিত।

সাধারণত ডাকাতের পূজিত বলে অনেকেই ভেবে থাকেন এই মন্দিরে কালী প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। কিন্তু চিত্তেশ্বরী মন্দিরে মা কালীর কোনো বিগ্রহ নেই, এই বিগ্রহ দেবী দশভূজা দুর্গার। চিতে ডাকাত এককালে এই বিগ্রহের সামনে হাড়িকাঠে নরবলিও দিত। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে দুর্গা বিগ্রহের সামনে নরবলি? হ্যাঁ, চিত্তেশ্বর ডাকাত নরবলিই দিত। যদিও এমন ঘটনা (দুর্গার সামনে নরবলি) খুবই বিরল। এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে যে মহিষমর্দিনী রয়েছেন তিনি কিন্তু একাই বিরাজ করেন, অর্থাৎ এই মন্দিরে দেবী সপরিবার নেই। তবে দেবীর বাহন সিংহ এখানে শ্বেতবর্ণের এবং একটি ছোটো বাঘের মূর্তিও আছে। দেবীর প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতার এই অঞ্চল যে সুন্দরবনের একটি অংশ হিসাবে জলাজঙ্গলময় ছিল এবং বাঘের উপদ্রব ছিল, এই মূর্তি তারই পরিচয় দেয়। এই বর্ণনা শুনে বুঝতেই পারছেন যে আদি চিত্তেশ্বরী মন্দিরে দেবী স্বয়ং একাই জ্যোতির্ময়ী চণ্ডী রূপে বিরাজ করছেন।

চিত্তেশ্বরীর বিগ্রহ কী ভাবে পাওয়া গেল, তা নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। ১৫৮৬ সালে নৃসিংহ ব্রহ্মচারী এসেছিলেন চিৎপুরে সাধনা করতে। একদিন গভীর রাতে দেবী আদেশ দিলেন তাঁকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করতে। পরের দিন বহু সন্ধানের পর পাওয়া গেল সেই বিগ্রহ, তার পর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল দেবীর এবং শুরু হল পুজো। তৎকালীন সময়ে কাশীপুরের এই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি ছিল মনোহর ঘোষ তথা মহাদেব ঘোষের জমিদারির মধ্যে। জমিদারের নির্দেশে কর্মচারীরা জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসে সাধক নৃসিংহ ব্রহ্মচারীকে দেখলেন। তাঁর কাছে দেবীর সমস্ত কথা শুনে জানালেন জমিদারবাবুকে। তখন মনোহর ঘোষ ৩৬ বিঘা জমি দান করে একটি মন্দির নির্মাণ করে দিলেন দেবীর জন্য। সময়টা ১৬১০ সাল। পরবর্তী কালে গোবিন্দরাম মিত্র নতুন করে মন্দিরটি সংস্কার করেন।

কলকাতায় বেশ কিছু রাজপথের নামকরণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ আগমনের বহু আগে থেকেই। একটি রাজপথের সূচনা হালিশহর থেকে এবং তা বিস্তৃত হয়েছিল কালীঘাটের কালীমন্দির পর্যন্ত। এই পথেই আজকালকার কাশীপুরে রয়েছে প্রাচীন চিৎপুরের আদি শ্রীশ্রীচিত্তেশ্বরী দুর্গা। শুরুতে এই রাজপথের নাম ছিল ‘পুরাতন রাস্তা’ বা ‘তীর্থক্ষেত্রে যাইবার পথ’ যা তৈরি করেছিলেন সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ। ব্রিটিশ কোম্পানির সময় এই রাজপথের নাম হয় ‘ওল্ড পিলগ্রিমেজ রোড’। এখনকার চিৎপুর এলাকা ও চিৎপুর রোডের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। বাগবাজার খালের উত্তর দিক থেকে কাশীপুরের গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি পর্যন্ত যে এলাকা বিস্তৃত, সেই এলাকাই হল চিৎপুর।

নৃসিংহ ব্রহ্মচারীর পর তাঁর শিষ্য রামনৃসিংহ ও প্রশিষ্য ক্ষেত্র ব্রহ্মচারী মোহন্ত হন। ঘটনাচক্রে বিবাহ করতে বাধ্য হন ক্ষেত্র ব্রহ্মচারী। তাঁর দুই কন্যা – জ্যেষ্ঠা কন্যা যদুমণির বিবাহ হয় এক অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে এবং কনিষ্ঠা কন্যা ক্ষেত্রমণির বিবাহ হয় হালিশহরের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বংশজ আনন্দমোহন রায় চৌধুরীর সঙ্গে। সেই থেকে হালিশহরের রায় চৌধুরী পরিবারই চিত্তেশ্বরী দুর্গার সেবা করে আসছেন। হালিশহরের কাশীশ্বর রায়চৌধুরী ও ইন্দ্রা রায়চৌধুরী বর্তমানে এই মন্দিরের সেবায়েত। এখানে দুর্গাপুজো শুরু হয় মহালয়া থেকেই। সেই সময় দেবীকে রাজবেশ পরানো হয়। বহু ভক্তসমাগম ঘটে পুজোর সময়। নানান রকমের ভোগের পদ রান্না করে দেবীকে নিবেদন করা হয়। হোম, আরতি-সহ সমস্ত আচারই আগেকার প্রথা মেনেই করা হয়। নিমকাঠের বিগ্রহে অঙ্গরাগ, চক্ষুদান, প্রাণপ্রতিষ্ঠা সব কিছুই। আগে চিতু ডাকাতের সময় নরবলি হলেও পরবর্তীতে ছাগবলি শুরু হয়। এখন তা-ও বন্ধ হয়ে শুধুমাত্র ফল বলি দেওয়ার রীতি।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img