হোমPlot1নানারূপে লক্ষ্মী, ধনদেবীর বাহন পেঁচা কেন?

নানারূপে লক্ষ্মী, ধনদেবীর বাহন পেঁচা কেন?

নানারূপে লক্ষ্মী, ধনদেবীর বাহন পেঁচা কেন?

সায়ন্তন বিশ্বাস
প্রবাদ আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর রাতে দেবী খোঁজ নেন, কে জেগে আছেন! যিনি জেগে থেকে অক্ষক্রীড়া করেন, দেবী তাঁকে ধনদান করেন। এখন প্রশ্ন “কে জেগে আছে!” “অক্ষক্রীড়া” শব্দের অর্থই বা আমরা কী বুঝব?

“অক্ষ” শব্দের এক অর্থ পাশক। পাপী মূর্খরা ধরে নিয়েছে লক্ষ্মীপুজোয় সারারাত জেগে পাশা খেলা হয়তো ধনদেবীর অভিপ্রেত। কোথাও আবার পাশা খেলার জায়গায় অন্যের ক্ষতিসাধন করা অভিপ্রেত বলে মনে হয়। যেমন বাগানের ফলমূল চুরি বা বাগানের তৈরি গাছপালার ক্ষতি করার মতো লৌকিক আচারও আছে। যারা বৈশ্য অর্থাৎ রাজসিক গুণ সম্পন্ন, তাঁরা দেবীকে স্মরণ মনন আরাধনাপূর্বক ক্রয় বিক্রয় বা বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুচিন্তন করেন।

অক্ষ শব্দটির নানারকম অর্থ আছে। সেই সব এর মধ্যে সবথেকে উৎকৃষ্ট অর্থ হল, “আত্মা”, “রুদ্রাক্ষ”, “জপমালা”। যারা শুদ্ধসত্ত্বপ্রধান, তাঁরা অক্ষক্রীড়া মানেই বুঝবেন, জপমালা নিয়ে সারারাত লক্ষ্মীর ধ্যান। “কো জাগত্তি” বাক্যটি তাদের কাছে আত্মচৈত্যনয়স্বরূপ। আত্মার, বিবেকের, স্বরূপের  দিক থেকে যিনি জেগে থাকেন তিনি দেবীর শ্রেষ্ঠ বর লাভ করেন, মোক্ষলাভ করেন। উপনিষদ সেই জন্যে নির্দেশ দিলেন, “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধিত”।

ধ্যানমালা ও স্তোত্র থেকে দেবীর যে স্বরূপ আমরা পাই, তাতে উনার হাতে পাশ ও অঙ্কুশ; উনার অঙ্গকান্তি কাঞ্চনসন্নিভ অর্থাৎ সকালের মিঠে বালসুর্যের মতন। চারটি বিশাল হস্তী তাকে সর্বদা বারিসিঞ্চনের মাধ্যমে অভিষেক করে যাচ্ছে।নদৈবাসুরের সমুদ্রমন্থনে ঋষি দুর্বাশার শাপমুক্ত হয়ে উঠে এসেছেন সমুদ্র থেকে। তিনি রুক্মিণী, তিনি সীতা, তিনি সমুদ্র উদ্ভবা। হাতে তার শালিধানের মঞ্জুরী ও পদ্ম আর বক্ষে কৌস্তভ মণি। অগ্নিপুরাণের  শ্রী স্তোত্র অনুযায়ী – শ্রী বা লক্ষ্মীই যজ্ঞবিদ্যা। তিনিই আত্মবিদ্যা, যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা, মহাবিদ্যা তিনিই এবং তিনিই বিমুক্তি ফলদায়িনী
“যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা
আত্মবিদ্যা চ দেবি ত্বং বিমুক্তিফলদায়িনী”।

দেবীর বাহন পেঁচাকে দেখলে আপাতভাবে মনে হতেই পারে, মা লক্ষ্মীর সবই ভাল খালি বাহন নির্বাচনই সঠিক করেননি উনি। শ্রী, সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য্য, সৌভাগ্যের দেবীর বাহন কদাকার, দিবান্ধ, কর্কশ, হিংস্রস্বভাবী পেঁচা!  উত্তরে বলতে চাই, দেবীর সঙ্গে পেঁচার সম্মেলন খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। সামাজিক দিকে এই পেঁচার রূপক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

মানুষের মধ্যে এরকম কিছু অর্থলোলুপ পিশাচ শ্রেণির মানুষ আছে, যারা রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠতে চায়। তারা পেঁচার মতই হিংস্র, দিনের বেলায় নিরীহ, গোবেচারা ; কিন্তু রাত্রি হলেই ধরা পরে আসল রূপ। এখানেই লক্ষ্মী অলক্ষ্মী, “কলহঙ্কুরা”। এর সাধনা  করে কারা ?

উত্তর হল, অসুর, দানব, ভোগবাদীরা। কিন্তু আমাদের আর্য হিন্দুরা তো এনাকে চাননি। চেয়েছেন – “ধর্মরূপিনী, বিদ্যারূপিনী” লক্ষ্মীকে। পেঁচা নিরর্থ নয় এখানেও। দেবী যেন আমাদের বলছেন, “আমার বাহন যেমন দিনের বেলায় অন্ধ, তুমিও তেমনি পরধন সম্পর্কে অন্ধ হও ; পাপের পথ , পরশ্রীহরণের পথ , দস্যুবৃত্তির পথ এবং সর্ববিধ দুর্নীতির পথ দেখোনা তুমি; সে পথে গেলে যমের দন্ড অপেক্ষা করছে, তা আমার বাহন কে দেখেই সংযত হও। ধন উপার্জন করতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে ঠিক উপায়ে, ধর্মীয় বুদ্ধিতে। অর্থব্যয় ও স্বকীয়ভোগ এর জন্যে নয়।”

মা লক্ষ্মী কৃষিসম্পদেরও দেবী। ধান, গম, ফলমূল বনসম্পদ উৎপন্ন হয় মাটি বা ভূমি থেকে। তা লক্ষ করেই স্তুতিতে তার নাম রাখা হয়েছে “ভুলীলা”। কিন্তু বিনা লাঙলে চাষ কী করে সম্ভব? তাই তিনি সীতা বা লাঙলও। শুধু কর্ষণে হবে না, চাই বর্ষণও। তাই তাঁর হাতে বর্ষণের দেবতা ইন্দ্রের চিহ্ন অঙ্কুশ। কিন্তু সৌরতেজ, সমুদ্র ছাড়া বর্ষণ কী করে সম্ভব? তাই তার অন্য হাতে বরুণদেবের চিহ্ন পাশ আর দেবীকে বলা হয়েছে দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম বিষ্ণুর প্রিয়তম পত্নী। দেবীর অঙ্গবর্ণেও ধরা পড়ে ধান্য বর্ণ। চার বিশাল হস্তীর সবসময় দেবীকে অভিষিক্ত করা কি শস্যচারার উপর সর্বদা জলসেচকেই বোঝায় না? লক্ষ্মী পুজোর সময়টি ও শরৎকালে – ধানের পূর্ণ ফলনের সময়। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলাই যায়- দেবী নিত্য কৃষিময়ী।

অথর্ব বেদীয় নৃসিংহতাপনী উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় মন্ত্রে মহালক্ষ্মী- উপদিষ্ট। লক্ষ্মীর ধ্যানস্তুতির মধ্যেও তার অধ্যাত্ম মহিমার প্রকাশ। তিনি শুধু নদীরূপা, ধনদেবী, বাণিজ্যবৃদ্ধি, পশুসম্পদ, রাজ্যসম্পদ, শিল্পসম্পদের দেবী নন , ইনি চরিত্রবিদ্যা, যজ্ঞবিদ্যা, আত্মবিদ্যার ও দেবী। ইনি শুভা , নিত্যা, সতী। তার শ্রীহস্তে অক্ষমালা বা জপমালা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তিনি বিমুক্তফলপ্রদায়িনী, তিনি পারমার্থিক ধনের মুক্তিধনের ও উৎস। এখানেই তিনি মহালক্ষ্মী যিনি জাগতিক সুখ সম্পদ, সৌভাগ্য ধনসম্পদ এর ঊর্ধ্বে আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান , ব্রহ্মস্বরূপ, দান করেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দেবীর মহালক্ষ্মী, লক্ষ্মী, অলক্ষ্মী মনুষ্যের সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক গুণের প্রতীক।

সংসারে যেমন মাতাপিতা উভয়ের আশীষে সন্তানের কল্যাণ হয়, তেমন বিষ্ণুকে যা়রা উপাসনা করেন, জগৎপিতা হিসেবে ভজনা করেন, লক্ষ্মী তাঁদের কাছে মা; মায়ের কাছে চাইলে পিতার করুণা লাভ হয় সহজতর, মুক্তিলাভও হয় ত্বরান্বিত।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img