(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)
হীরক কর : জঙ্গলমহলে ছত্রভঙ্গ মাওবাদীরা। এই পরিস্থিতিতে গঠিত হয়েছে মাওবাদীদের নতুন রাজ্য কমিটি। আর তাতে স্থান পেয়েছেন একজন বাঙালি সাংবাদিক। যিনি নাকি আবার কলকাতার। আর তাতেই ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে কলকাতার মিডিয়া মহলে ।
এই সাংবাদিক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সি। তাদের কাছে প্রশ্ন, কে এই বাঙালি সাংবাদিক? কোন মিডিয়া হাউসে তিনি কাজ করেন? কেননা ওই সাংবাদিকের গতিবিধি এবং পরিচয় এখনও গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো জানে না।
এদিকে বিধানসভা ভোটের মুখে আত্মসমর্পণ করতে পারেন ভারতের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন সিপিআই(মাওবাদী)-র প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অসীম মন্ডল ওরফে ‘আকাশ’। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা জানিয়েছেন, বহুদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন অসীম মন্ডল। তার ব্লাড সুগারও ধরা পড়েছে। সুগারের জেরেই এখন ভালো করে দেখতে পান না আকাশ। এখনই কলকাতা এনে তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন। তাই জঙ্গলের জীবন ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে চাইছেন তিনি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাই তাঁর লক্ষ্য।
গোটা বিষয়টি দেখভাল করছেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের এক দুঁদে গোয়েন্দা কর্তা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মূলস্রোতে ফেরা এক মাওবাদী স্কোয়াড লিডারকে সামনে রেখে এই মধ্যস্থতা চলছে। ওই গোয়েন্দা কর্তার মতে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই আত্মসমর্পণ হবে ভোটের মুখে। যদি রাজ্য পুলিশের উদ্যোগে আকাশের মত শীর্ষস্তরের মাওবাদী নেতা আত্মসমর্পণ করেন, তবে ভোটের মুখে তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
কয়েক বছর আগে আত্মসমর্পণ করেন মাওবাদী শীর্ষনেতা রঞ্জিত পাল এবং তাঁর স্ত্রী অনিতা। মাওবাদী সংগঠনের বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা সীমান্তে এরিয়া কমান্ডার ছিলেন রঞ্জিত। ১৭ বছর ধরে তাঁর খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছিল পুলিস। কিষেণজির মৃত্যুর পর, এ রাজ্যে সংগঠনের অনেকটাই দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরে। আত্মসমর্পণের পর রঞ্জিত বলেন, ‘”সহিংস পথে জনগণ ও সমাজের ভাল করা সম্ভব নয়। যে সমস্যাগুলো ছিল, রাজ্য সরকার উদ্যোগ নিয়ে সেগুলির সমাধান করেছে। তাই আমাদের মূলস্রোতে ফেরার সিদ্ধান্ত।”
রঞ্জিত ওরফে তড়িৎ দলমা-অযোধ্যায় সংগঠনের মূল দায়িত্বে ছিলেন। বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজকর্মে তাঁর যোগ পাওয়া যায়। ২০০৩ সালের পর থেকে সমস্ত মাওবাদী হানায় রঞ্জিতের নাম উঠে আসে। ঝালদা গণহত্যার মতো একাধিক হামলায় জড়িতও ছিলেন। এ রাজ্যে পুলিশের সক্রিয়তায় সম্প্রতি মাওবাদীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
কিষানজির মৃত্যুর পর রাজ্য সংগঠনকে মজবুত করা এক প্রকার চ্যালেঞ্জ ছিল মাওবাদী নেতৃত্বের। কিন্তু একে একে শীর্ষনেতারা আত্মসমর্পণ করায় অসুবিধায় পড়েন মাওবাদীরা। ২০১০-এর পরে ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যান রঞ্জিত। শেষপর্যন্ত স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা পুলিশের এসটিএফের কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন রঞ্জিত।
রঞ্জিতের স্ত্রী ঝর্না গিরি ওরফে অনিতাকেও দশ বছর ধরে খুঁজছিল পুলিস। তবে মাও দম্পতির নাগাল পাননি গোয়েন্দারা। গত দু’বছরে রাজ্যে ২১৯ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন। মাওবাদীরা এখন মূলস্রোতে ফিরতে চাইছে। জঙ্গলমহলের মাওবাদী নেত্রীদের মধ্যে এর আগে সোমা মান্ডি, জাগরী বাস্কে ও সুচিত্রা মাহাতো আত্মসমর্পণ করেন।
কিষানজির মৃত্যুর পর এই রাজ্যে মাওবাদীদের সংগঠন রীতিমত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। সাত-আটটি গোষ্ঠীতে ভেঙে গেছে সংগঠন। পুলিশের দালাল হিসাবে চিহ্নিত হওয়া, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার চরিতার্থ করতে কয়েকজনকে থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, আদর্শগত মতভেদ, এই দলটাকে টুকরো-টুকরো হতে সাহায্য করেছে। মাঝে মাঝে অবশ্য পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর, পুরুলিয়া ঝালদা, বাগমুন্ডি, থানা এলাকায় মাওবাদীদের পোস্টার পুলিশের নজরে এসেছে।
সম্প্রতি ঝালদা বন দফতরের একটি বিট অফিসের দেওয়ালে থেকে মাওবাদীদের পোস্টার ছিঁড়েছে পুলিশ। তবে গোয়েন্দা কর্তারা এইসব পোস্টার হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, মাওবাদীরা এখন এতটাই দুর্বল যে, স্থানীয়ভাবে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে মাওবাদীদের নামে এইসব পোস্টার ফেলছে লোকাল ছোটখাটো বিজেপি, তৃণমূল নেতারা। এই পরিস্থিতিতে অতীতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্য কমিটি করেছে মাওবাদীরা।
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে জঙ্গলমহলে দুর্বল সংগঠনকে জোরদার করতে চমকপ্রদ পদক্ষেপ নিয়েছিল তৃণমূল। রাজ্য কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছিল জেল ফেরত জনসাধারণ কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতোকে। এবার সেই রকমই চমকে দেওয়া পদক্ষেপ নিয়েছে মাওবাদীরা। তাদের রাজ্য কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ওই বাঙালি সাংবাদিক।
গোয়েন্দারা তাদের সোর্সের মাধ্যমে শুধু এইটুকু জানতে পেরেছেন, সিপিআই(মাওবাদী)-র রাজ্য কমিটিতে স্থান পাওয়া কলকাতার এই সাংবাদিক চরমপন্থায় বিশ্বাসী। সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করার সময় থেকেই তিনি মোবাইলে মাওবাদীদের বিভিন্ন নেতা, কমান্ড্যান্টের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। তিনি নাকি বিভিন্ন গুপ্তচর এজেন্সির গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে কলকাতাতে মাওবাদীদের একটি শাখার সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
তিনি একাধিক নামী ইংরেজি ন্যাশনাল দৈনিক সংবাদপত্রের কাজ করেছেন। নামী বাংলা সংবাদপত্রের কাজের সুবাদে তিনি কলকাতার সাংবাদিক মহলে অতি পরিচিত নাম। তাই তাঁর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান গোয়েন্দারা। তাতেই স্বাভাবিক নিয়মেই ওই বাঙালি সাংবাদিকের এখন ‘হার্ট বিট’ বেড়ে গেছে। গোয়েন্দারা তাদের পরিচিত সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদও করছেন, ‘কিছু জানো কিনা’। কিন্তু এখনো এজেন্সিগুলো অন্ধকারে।