হোমPlot1শীল আর চাটুজ্যে, চোরবাগানের দুই বনেদি বাড়ির পুজোর গরিমা আজও অটুট

শীল আর চাটুজ্যে, চোরবাগানের দুই বনেদি বাড়ির পুজোর গরিমা আজও অটুট

শীল আর চাটুজ্যে, চোরবাগানের দুই বনেদি বাড়ির পুজোর গরিমা আজও অটুট

শুভদীপ রায় চৌধুরী
বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে ভিড় করার পাশাপাশি বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে ভিড় করেন দেশবিদেশের দর্শনার্থীরা। ধুনোর গন্ধ আর ঠাকুরদালানের বিরাট বিরাট ঝাড়বাতির আলো নিজেদের গায়েও মাখতে ভিড় করেন তাঁরাও।

উত্তর কলকাতার চোরবাগানের শীল পরিবারের দুর্গাপুজো বহু প্রাচীন। এই বংশের সুসন্তান রামচাঁদ শীল ও তাঁর স্ত্রী ক্ষেত্রমণিদেবী  দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। তবে ১৮৫৫ সালে এই বাড়িতে প্রথম শুরু হয় দোল উৎসব। ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৬ সালে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয় শীল বাড়িতে। তবে রামচাঁদের আর্থিক অবস্থা প্রথমে ভালো ছিল না। তাঁর বাবা হলধর শীলের অবস্থা ভাল না থাকায় মা রেবতীমণির সঙ্গে চন্দননগরের মামার বাড়িতে চলে আসেন রামচাঁদ, সেখানেই বড় হয়ে ওঠেন। পরে মাসতুতো ভাই মদনমোহনের সহায়তায় গ্ল্যাডস্টোন কোম্পানিতে চাকরি পান রামচাঁদ।

কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন বলেই খুব সহজেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েন এবং পরবর্তীকালে ওই কোম্পানিরই বেনিয়ান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। প্রভূত অর্থ উপার্জনের পর রামচাঁদ কলকাতায় তৈরি করেন বসতবাড়ি এবং প্রতিষ্ঠা করেন কুলদেবতা দামোদর জিউকে। একইসঙ্গে শুরু করেন দোল এবং দুর্গোৎসব। কিন্তু প্রভূত অর্থ উপার্জন করার পরেও নিজের অতীত ভোলেননি রামচাঁদ। তাই আর্ত মানুষ দেখলেই ছুটে যেতেন তাঁকে সাহায্য করতে। শীলবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন গরীব-দুঃখী, অভাবী মানুষদের জন্য।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে পুজো হয় এই বাড়িতে। মায়ের ভোগে থাকে লুচি, ফল আর নানান মিষ্টি। মহাষ্টমীর সকালে ধুনো পোড়ানো আর দুপুরে গাভী পুজো, এই পরিবারের বহু প্রাচীন রীতি। এর পাশাপাশি, মহনবমীতে কুমারী পুজো ও সধবা পুজোর আয়োজন করা হয় শীলবাড়িতে।

চোরবাগানের এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সন্ধিপুজোয় বলির বদলে ধ্যান করেন পরিবারের সদস্যরা। পুজোর দিনগুলিতে অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে নবমী নিরামিষ আহার করেন বাড়ির সদস্যরা। খাবারের অভিনবত্ব বলতে, শুক্তোয় পাটপাতা দেওয়া হয়, থাকে পানিফল ও পাঁপড়ের ডালনা। দশমীর দিন সকালে দর্পণ বিসর্জনের পর বিকেলে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় শীলবাড়িতে।

মধ্য কলকাতায় শীলদের পাশাপাশি চট্টোপাধ্যায় পরিবারও রয়েছে, যে বাড়িতে বহু বছর ধরে উমার আরাধনা হয়ে আসছে প্রাচীন রীতি মেনে। এই অঞ্চলের রামচন্দ্র ভবনের নির্মাতা রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বসতবাড়ির ঠাকুরদালানে ১৮৬১ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেন স্ত্রী দুর্গাদাসীর পরামর্শে।চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় বাড়ি

এই পরিবারের সন্তান রামচন্দ্র বহু টাকা উপার্জন করে ১২০ নং মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে এই বাড়িটি তৈরি করেন। আর সেই বাড়িতেই ধুমধাম করে পুজো শুরু করেন তিনি। বনেদি বাড়িতে রথের দিন কাঠামোপুজো হলেও, চ্যাটার্জি বাড়িতে জন্মাষ্টমীতে কাঠামোপুজো হয়। এদিন একটি লাঠিকে (পরিবার সূত্রে জানা যায়, এই লাঠির বয়স পুজোরই সমসাময়িক) পুজো করা হয় এবং তারপর সেই লাঠিটি দিয়ে আসা হয় কুমোরটুলিতে। সেখানেই নিমাই পালের স্টুডিওতে মৃন্ময়ী তৈরি হন।

অতীতে শিল্পী নিমাই পালের পূর্বপুরুষেরা চট্টোপাধ্যায় পরিবারে এসেই ঠাকুর তৈরি করতেন। তবে বর্তমানে কুমোরটুলি থেকেই মা আসেন চ্যাটার্জি বাড়িতে, দেবীপক্ষের দ্বিতীয়ায়। অতীতে এই বাড়িতে ডাকের সাজের প্রতিমা হলেও, পরবর্তীকালে পরিবর্তন করা হয়েছে সাজসজ্জাতে। দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন মাকে বেনারসী শাড়ি এবং বিভিন্ন প্রাচীন স্বর্ণালঙ্কার পরানো হয়।

ষষ্ঠীর দিন রাত্রে বেলবরণ উৎসব হয় এই বাড়িতে। সেদিন বাড়ির মহিলারা গভীর রাতে মায়ের চার দিকে প্রদক্ষিণ করে বরণ করেন ও দেবীকে স্বাগত জানান সে বছরের জন্য। সপ্তমীর দিন বাড়িতেই নবপত্রিকা স্নান করানো হয়।

চ্যাটার্জি বাড়িতে ভোগ রান্না করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। খিচুড়ি, নানান রকমের ভাজা, শুক্তনি, চিংড়িমাছের মালাইকারি, ভেটকিমাছের ঘণ্ট, লাউচিংড়ি, চাটনি, পায়েস, পানতুয়া ইত্যাদি নানান রকমের ভোগ রান্না করে মাকে নিবেদন করা হয়। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন হয়  দুর্গা-অরন্ধন দিবস, অর্থাৎ আগের দিন সমস্ত রান্না করা হয়। সেদিনের ভোগ থাকে পান্তাভাত, ইলিশমাছের অম্বল, চাতলার চাটনি, কচুশাক ইত্যাদি। এই দিন পরিবারের সদস্যরা সকলে মিলে মায়ের সামনে এক প্রার্থনাসংগীত পরিবেশন করেন। দেবীর কাছে অশ্রুজলে প্রার্থনা জানান ১৬ পঙক্তির স্তব গেয়ে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img