অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
রজনীকান্ত সেন। তিনি কান্তকবি, তিনি সঙ্গীতকবি, গীতিকার, সুরকার, এবং গায়ক। ২৬ জুলাই তাঁর জন্মদিন। ১৮৬৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বেলকুচির ভাঙাবাড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গানের পাশাপাশি রজনীকান্ত সেনের গানের ঘরানা বাংলার সঙ্গীতপিপাসু মানুষকে আজও জারিত করে রয়েছে।
যদি জানতে চাই, আমার কাছে ‘তিনি’ কী পেলেন! সেই মস্তবড় সত্তা, সেই অমিত-বিরাট, যিনি এই অকৃতী-অধমকে সব কিছুই দিয়েছেন, অযোগ্য বিবেচনা করে সামান্যতম কিছু কেড়েও নেন নি, তিনি কে! তাঁর আশীর্বাদীফুল মাথায় ঠেকাই নি আমি কোনোদিন; হয়তো আশীষ-কুসুম পায়েই দলে চলে গেছি, ফিরেও তাকাই নি, তবুও তো তার দয়া পেয়েছি অনুক্ষণ, প্রতিদানে তাঁকে কিছুই দিই নি! তিনি আমাকে বাঁধনে এঁটে রাখতে চেয়েছেন, আর এই ‘ক্ষুদ্র আমি’ শতবার সেই বাঁধন কেটে চলে গেছি। অতএব, আমায় ছেড়ে গেছেন বিবেচনা করে, যখন পিছনে তাকালাম, বুঝলাম এক পা-ও তিনি যান নি। আমারই জন্যে রয়েছেন। এই অহেতুকী দয়ার কথা লিখেছেন রজনীকান্ত সেন —
“আমি অকৃতী অধম
ব’লেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি
যা দিয়েছ তারি
অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।
তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দলে গেছি চাহি নাই ফিরে
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ
প্রতিদান কিছু চাওনি।
আমি ছুটিয়া বেড়াই
জানিনা কি আশে
সুধা পান করে মরি গো তিয়াসে
তবু যাহা চাই সকলি দিয়েছ
তুমিও তো কিছুই পাওনি।
আমায় রাখিতে চাহ গো বাঁধনে আঁটিয়া
শতবার যায় বাঁধন কাটিয়া
ভাবি ছেড়ে গেছ ফিরে চেয়ে দেখি
এক পা-ও ছেড়ে যাওনি।”
ঈশ্বর আরাধনার মধ্যেই তিনি স্বদেশপ্রেমকে যেন গেঁথে দিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আর কখন যেন ব্রহ্মময়ী মা দেশমাতৃকা হয়ে উঠলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় অনুপম গভীরতায়, অতল আবেগে লিখে ফেললেন দেশপ্রিয় গান, “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই।” এ এক আত্মনির্ভরতার গান, দেশীয় পণ্যকে গ্রহণ করার দীক্ষা-সঙ্গীত। তাঁর গীতি সংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বাণী’ ‘কল্যাণী’, ‘অভয়া’ প্রভৃতি, এগুলি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল (১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের পূর্বে)।
“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;
তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে৷” — এই বিখ্যাত গানের মধ্যে তিনি পুরোপুরি আত্মনিবেদনের কথা বলেছেন। ত্রিস্তরীয় গান রচনার মধ্যে দেশাত্মবোধ, ঈশ্বর আরাধনার গান ছাড়াও নীতিবোধ ও হাসির গান রচনাও ছিল্য
রজনীকান্ত সেনের কাছ থেকে আমরা শিখেছি সক্ষমতা কাকে বলে। শ্বাসনালীর ক্যান্সার; ফলে তার অবশ্যম্ভাবী অস্ত্রোপচারের ফলে বাকশক্তি হারিয়েও তিনি সৃজনশীলতা চালিয়ে গিয়েছেন সমান দক্ষতায়। এমনকি হাসপাতালে বসেই লিখেছেন গান ও গদ্য। এমন একজন প্রেরণাদানকারী ব্যক্তিত্ব রজনীকান্ত। আজও তাঁর গানের কথায় ও সুরে আমরা মোহিত হই। ঈশ্বর আরাধনায় জেগে উঠি, স্বদেশপ্রেমে জারিত হই। রজনীগন্ধার সুবাসের মতো আমরা রজনীকান্ত সেনকে মনে রাখবো যদি না রজনীকে নিকষ কালো করে ফেলি।