ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
(ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনীতির পরিমণ্ডলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কিংবা মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, কেউ কারোর দ্বারা আচ্ছাদিত হতে পারেন না। যদি আচ্ছাদন থেকেই থাকে, তবে তা আমাদেরই পক্ষপাতদুষ্ট নেত্রপল্লবে। লিখেছেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।)
“কালী হলি মা রাসবিহারী/নটবর বেশে বৃন্দাবনে/পৃথক প্রণব, নানা লীলা তব,/ কে বুঝে এ কথা বিষম ভারী।” এ একটি রামপ্রসাদী গান। ভগবান কৃষ্ণই যে ‘রাসবিহারী’ সেই প্রথম শুনলাম। তার আগেই রাসবিহারী বসুর নামটি শুনেছি। তাঁর জীবনী পাঠ করে শুনিয়েছেন বাবা। শুনেছি তাঁর নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করার রোমহষর্ক লোকায়তিক কাহিনী, যা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। তখন থেকে এবং পরবর্তী যৌবনে একটা ধারণা জন্মাচ্ছিল, ঈশ্বরপ্রেম, দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম ইত্যাদি ‘প্রেম’-মূলক নানান অনুভূতি বোধহয় অভিন্ন। রাসবিহারী বসুর ছদ্মবেশ ধারণ করে ইংরেজদের চোখে ধুলো দেওয়াটা তখন মনে হয়েছিল মা কালীর রাসবিহারী রূপ পরিগ্রহণ, এতটাই নিখুঁত। রাসবিহারীর ছদ্মবেশ ধারণের রোমহষর্ক বর্ণনা শুনে শিশুমনে যে নানান চিত্রকল্পের উদয় হয় তা এমনতর।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, দেশের জন্য লড়াই, তখন আমাদের কাছে একটি অভূতপূর্ব অনুভূতি এনে দিতো। ছোটবন্ধুরা খেলাচ্ছলে জিজ্ঞেস করতো কে, কার মতো বিপ্লবী হতে চাই? কেউ নেতাজির কথা বলতো, কেউ অরবিন্দ, কেউ মাস্টারদা। আমার নিঃসন্দেহে রাসবিহারী বসুর (Rashbehari Bose) নামটি আসতো। ভারতের বাইরের কোনো দেশকে যদি ছোটোবেলা থেকে ভালোবেসে থাকি, তা হচ্ছে জাপান।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে অসীম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েও, রাসবিহারীকে কখনও কম শ্রদ্ধা করতে শিখিনি। পরে যতই রাসবিহারী সম্পর্কে উদাসীনতার সামাজিক ছবি দেখেছি, ততই রাসবিহারীর উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। অশেষ কষ্ট সয়ে বিদেশে থেকে ভারতবর্ষের জন্য তিন দশক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নজির আর কোন বিপ্লবীর রয়েছে?
১৯১২ সালে দিল্লি এবং ১৯১৩ সালে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় নানান অনুসন্ধান করে ব্রিটিশ সরকার জানতে পারে মূল পাণ্ডা তিনিই। তখন তাঁর মাথার দাম ধার্য হয় ১২ হাজার রুপি। তবুও তিনি অধরা। মাথার দাম আরও বাড়লো ৫ হাজার রুপি। চারদিকে খোঁজ খোঁজ। হাটে, জনপদে, স্টেশনে-স্টেশনে ছবি সহ পোস্টারে ছয়লাপ৷ না, তবুও তাঁকে ধরা যাচ্ছে না। ছদ্মবেশ ধারণ করছেন নিঁখুত ভাবে। নানা নামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং গোপনে বিপ্লবের কাজ সংঘটিত করে চলেছেন ভারতের নানা জায়গায়।
কখনও সন্ন্যাসীর বেশ, কখনও শ্রমিক কারিগর, দারোয়ান, কাজের লোক, কখনও নারীর বেশ। তারই মধ্যে এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৪ সাল। পরিস্থিতি বুঝে এবার সেনাবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা চালালেন, যাতে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম সুযোগ নেওয়া যায়। দিল্লি, লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডি, আম্বালা, মীরাট, জব্বলপুর, বেনারস, দানাপুর প্রভৃতি স্থানের সেনাছাউনিগুলিতে বার্তা পৌঁছে দিতে লাগলেন। কিন্তু না, ১৯১৫ সালে জনৈক সদস্য সবকিছু ফাঁস করে দিলেন।
বিদ্রোহের সূত্রপাত ও বাতাবরণ তৈরি হয়েও প্রবল দমনপীড়নের ফলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হল ব্রিটিশ প্রশাসন। ভারতে থাকা আর নিরাপদ নয় বুঝে, সহ বিপ্লবীদের পরামর্শে দেশত্যাগ করে জাপানে পৌঁছলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান যেতে পারেন এই খবর পেয়ে, তাঁর সচিব সেজে নাম নিলেন ‘পি এন ঠাকুর’। জাপানেই পরিচয় হল প্যান এশিয়ানিজমের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে। সেখানেও একসময় আত্মগোপন করে কাজ করতে হল। অবশেষে জাপানি সহযোদ্ধাদের পরামর্শে জাপানি কন্যাকে বিয়ে করে নিতে হল সেখানকার নাগরিকত্ব। রেস্টুরেন্টের আড়ালে চলল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গোপন বিপ্লবী কাজ। যোগাযোগ হতে লাগলো জাপানি সামরিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে, ভারতপন্থী রাজনীতিক ও প্রবুদ্ধজনের সঙ্গে। পরিকল্পনাকে তিলে তিলে রূপদান করে এভাবেই একদিন ডাক দিলেন ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে।
১৯৪২ সালের ২৮-৩০ মার্চ। টোকিও-তে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ডাকে এবং সভাপতিত্বে জাপান, চীন, মালয় এবং শ্যামদেশের বহু ভারতীয় প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক হয়, প্রবাসী ভারতীয়রা ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লিগ’ নামে সরকারি দল এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নামে একটি সেনাবাহিনী গঠন করা হবে।
১৯৪২ সালের ২০-২৩ জুন। লিগের দ্বিতীয় সর্বভারতীয় প্রবাসী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ব্যাঙ্কক-এ। এখানে জাভা, সুমাত্রা, ইন্দোচীন, হংকং, বর্মা, মালয়, শ্যামদেশ থেকে ১০০ জন প্রতিনিধি যোগদান করলেন। উপস্থিত হলেন জাপান অধিকৃত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি শিবিরের প্রতিনিধিরাও।
২২ জুন তৈরি হয়ে গেল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ। ঠিক হল, লিগের সশস্ত্র শাখা ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ -এর আধিপত্য থাকবে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট Council of Action বা সমর পরিষদের উপর। পরিষদের অন্তর্বতীকালীন প্রথম সভাপতি হলেন রাসবিহারী বসু। অন্য সভ্যরা হলেন – এন রাঘবন, কে পি কে মেনন, ক্যাপ্টেন মোহন সিং এবং কর্নেল জি কিউ গিলানি। ভারতীয় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পতাকা জাতীয় পতাকা হিসাবে গৃহীত হল। ঠিক হল, সুভাষচন্দ্র বসুকে বার্লিন থেকে এশিয়ায় আসার অনুরোধ করা হবে।
এর পরেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে যে স্থানে ভারতীয়রা রয়েছেন, সেখানে লিগের বহু শাখা খোলা হল। বহু সিভিলিয়ান লিগের সভ্য হলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের জন্য মোহন সিং-এর নেতৃত্বে ভারতীয় বন্দি শিবির থেকে বহু ভারতীয় সেনাদলে যোগ দিলেন। তাঁদের সামরিক শিক্ষা শুরু হল। পেনাঙ-এ খোলা হল ‘স্বরাজ ইন্সটিটিউট’ নামে একটি শিক্ষা শিবির। লিগের সদস্য যুবকেরা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে গেলেন।
১৯৪৩ সালের ৪ জুলাই। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা হলের প্রকাশ্য সভায় রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লিগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বময় কর্তৃত্ব সুভাষের হাতে তুলে দিলেন। ৫ জুলাই সোনানের টাউন হলের সামনে আজাদ হিন্দ ফৌজের কুচকাওয়াজে সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন নেতাজি।
১৯৪৩, ২১ অক্টোবর। বেলা সাড়ে ১০টায় ডাই তোয়া গেকিজোতে পূর্ব এশিয়ার সব জায়গায় কার্যকরী ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লিগের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বে অনুষ্ঠিত হল সভা। প্রতিষ্ঠা হল আজাদ হিন্দ সরকারের। বিদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকার। নেতাজি দেড় ঘন্টার বক্তৃতার পর সর্বাধিনায়করূপে শপথ গ্রহণ করলেন, শ্লোগান দিলেন “দিল্লি চলো”। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেন রাসবিহারী বসু।
আজাদ হিন্দ সরকারের পদাধিকারীরা: সুভাষ চন্দ্র বসু – প্রধানমন্ত্রী (সমর ও বৈদেশিক বিভাগ), ক্যাপ্টেন ড. লক্ষ্মী স্বামীনাথন (মহিলা সংগঠন), এস. এ. আয়ার (বেতার, সম্প্রচার ও প্রকাশনা), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জী(অর্থ), লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এন. এস. ভগত, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জে. কে. ভোঁসলে, লেফটেন্যান্ট কর্নেলগুলজারা সিং, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. জেড কিয়ানি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ. ডি. লোগান্থন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইসান কাদের, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ নওয়াজ খান। এ. এন. সহায় (সেক্রেটারি), রাসবিহারী বসু (প্রধান উপদেষ্টা)।
অর্থাৎ বলা যায়, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর প্রথম প্রধান উপদেষ্টা রাসবিহারী বসু। নেতাজির মতো তিনিও বিশ্বের সব ঘটনাকে বাস্তবতার নিরিখে লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া করে, শত্রু-মিত্র জটিলতাকে সহজ সরল রূপ দিলেন, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধই যার অন্যতম চালিকাশক্তি। আত্মত্যাগ ছাড়া যে কোনও লড়াইয়ে শাশ্বত জয় সম্ভব নয়, তা তিনি ভারতবাসীকে, এমনকি বিশ্ববাসীকেও বুঝিয়ে দেন।
১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি মৃত্যু হয় এই মহাবিপ্লবীর। মৃত্যুর আগে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে জাপান সরকার ‘সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান’ অভিধায় সম্মানিত করেন।