(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর-এর কলমে।)
হীরক কর : আলিপুরের পশ এলাকায় গৃহবধূ রসিকা জৈনের মৃত্যু আত্মহত্যা না হত্যা, এই নিয়ে এখন বিতর্ক চরমে। রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশই। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শ্বশুরবাড়ি ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় রসিকার। পরদিন বিষয়টি জানতে পারেন রসিকার পরিবারের লোকজন। তাঁর বাবা-মায়ের অভিযোগ, গোটা ঘটনাটি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছে রসিকার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি। অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধেও।
ইতিমধ্যেই “জাস্টিস ফর রসিকা” নাম দিয়ে বহু মানুষ টুইট করেছেন। সেখানে রশিকার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি চিঠিও লেখা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাদের মেয়ে চার তলার ছাদ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঝাঁপ দিয়ে রহস্যজনকভাবে মারা গেছে। ওই চিঠিতে জামাই কুশল আগরওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। তিনি একটি সংস্থার ডিরেক্টর। তাঁকে নাকি গত ১৮ দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রশিকার দুটো ফোন, ল্যাপটপেরও নাকি হদিশ মিলছে না।
এখন তদন্তে নেমে নানা সূত্র হাতড়াতে হচ্ছে পুলিশ কর্তাদের। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আলিপুরের ডিএল খান রোডের একটি বিলাসবহুল আবাসনের নীচ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রসিকাকে। একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
পুলিশের একটি সূত্রে খবর, প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল রসিকার স্বামী কুশলের। তা নিয়ে রসিকার সঙ্গে নিত্য অশান্তি হত তাঁর। পুলিশের দাবি, ঘটনার দিনের যে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে, তাতে নাকি দেখা যাচ্ছে তিন তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন রসিকা জৈন আগরওয়াল। সিসিটিভি ফুটেজে যতটা দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিষ্কার, পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মারেনি রসিকাকে। ভিসেরা রিপোর্টও তাই বলছে। তাই, শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮ এবং ৩৯৬ ধারায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
রসিকার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট দেখে পুলিশের ধারণা, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র আগের দিন রসিকা এবং কুশলের মধ্যে ব্যাপক ঝামেলা হয়। স্বামীর প্রাক্তন বান্ধবীর কথা জেনে যান রসিকা। তাই নিয়ে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, যে ফোনটি রসিকা বেশি ব্যবহার করতেন সেটির কোনও খোঁজ নেই। রসিকার সঙ্গে তাঁর ননদের ফোনে যোগাযোগ হয়েছিল। কি কথা হয়েছিল, সেই তথ্যের খোঁজ চলছে।
রসিকার বাবা, রাজা সন্তোষ রোডের বাসিন্দা মহেন্দ্রকুমার জৈন আলিপুর থানায় লিখিত অভিযোগে জানান, গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তাঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ডিএল খান রোডের ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু মেয়ে সুখী ছিল না। তাঁর অভিযোগ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, মায়ের কাছে রসিকা জানিয়েছিলেন, ছোট ছোট বিষয়ে স্বামী তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। বাবা-মায়ের দাবি, মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের জেরেই মৃত্যু হয়েছে রসিকার। আত্মহত্যার সম্ভাবনা মানতে নারাজ তাঁর বাপের বাড়ির লোকজন।
ইতিমধ্যেই মহেন্দ্রকুমার জৈনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর জামাই কুশল আগরওয়াল ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, বধূ নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সেই তদন্তে উঠে এসেছে কুশলের প্রাক্তন প্রেমিকার নাম। ২০২০ সালে ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বছরের বিবাহবার্ষিকী। তার পরেই লকডাউন। ঘরবন্দি একান্ত দৈনন্দিন জীবনেই চমক ভাঙল রসিকার। স্বামী মাদকাসক্ত বলে অনুমান করেন এবং পরে এই নিয়ে অভিযোগও দৃঢ় হয় তাঁর। অশান্তি, ঝগড়া লেগেই থাকত।
সংবাদমাধ্যমে রসিকার বাবা বলেন, “মেয়ে কিছু দিন ধরেই তাঁর উপর অত্যাচার চলছে বলে জানিয়েছিল। বাড়ি নিয়ে আসার কথাও বলেছিল। কিন্তু বুঝতে পারিনি এমন দিন দেখতে হবে।” জৈন পরিবারের অভিযোগ, বিভিন্ন ধরনের নেশা করতেন কুশল। তাতে আপত্তি ছিল রসিকার। তাঁর উপর অত্যাচার চালাতেন জামাই। গত নভেম্বর মাসে অশান্তি মেটাতে রসিকার মা–বাবা ও অন্যরা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যান। কিন্তু আগরওয়াল পরিবার গেট থেকেই তাঁদের ফিরিয়ে দেয়। অভিযোগ, তারপরই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রসিকা তাঁর মা সঙ্গীতা জৈনের মোবাইলে একটি মেসেজ পাঠান। মেয়ে যে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে পারছেন না, তার ইঙ্গিত মেসেজে ছিল। কয়েক ঘণ্টা পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে ফোন করে তাঁদের বলা হয় যে, দুপুরে রসিকা ডি এল খান রোডের বাড়ির চারতলা থেকে পড়ে গিয়েছেন। বাড়ির প্রত্যেকে হাসপাতালে ছুটে যান। চিকিৎসা চলাকালীন হাসপাতালে রসিকার মৃত্যু হয়।
আগরওয়াল-বাড়ির দুই চাকর এবং দুই ড্রাইভারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জেরায় এই চারজন জানান, রসিকা কুশলের মধ্যে প্রায়শই ঝগড়া হতো। দুজনেই মাথা গরম করে ফেলতেন।আর রসিকার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে চাননি। তবে, কুশলের বাবা শিল্পপতি নরেশ আগরওয়াল জানান, ১৬ ফেব্রুয়ারি যখন ঘটনাটি ঘটে, তখন তিনি ও তাঁর ছেলে কেউই বাড়িতে ছিলেন না। এখন নরেশ, কুশল সহ গোটা পরিবারই নিখোঁজ। পনেরো দিন পর এই ঘটনা কেন চাগাড় দিল তাই নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ষোলোই ফেব্রুয়ারি ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি জানাজানি হতে ফেব্রুয়ারি মাস অতিক্রম করে গেছে। তাই আলিপুর থানার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আলিপুরের রাজা সন্তোষ রোডের ধনী তসর ব্যবসায়ী পরিবারের মেধাবী মেয়ে রসিকা। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করে সিঙ্গাপুর থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন। ২০১৯ সালে কলকাতার আরেক নামী শিল্পপতি নরেশ আগরওয়ালের ছেলে কুশলের সঙ্গে বিয়ে হয় রসিকার। নরেশের আদি বাড়ি রাজস্থানে হলেও বহু বছর ধরে তারা পুরুলিয়ার ঝালদার বাসিন্দা। সেখানে তিনি ছিলেন সাধারণ একটি রেশন দোকানের মালিক। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই তাঁর ফুলে ফেঁপে ওঠা। এগারো সালে তৃণমূল ক্ষমতায় এলে তিনি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হন। ঝালদাতেই “স্টার সিমেন্ট” নামে একটি কোম্পানির পত্তন করেন। কলকাতার দুর্গা পুজোয় তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠনে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিতে থাকেন। পুরুলিয়া শহরের নিস্তারিণী কলেজের উল্টো দিকে তার লাক্সারি হোটেল “পার্ল ট্রি”। পুরুলিয়ায় গেলে সেখানেই নাকি ওঠেন শাসকদলের ছোট বড় নেতারা। ঝালদায় তাঁর একটি ফার্ম হাউস আছে, যা নাকি দেখার মত। সেখানে বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের অবাধ যাতায়াত। পুরুলিয়া শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে এক বিশাল পাঁচতারা হোটেল করতে রাজ্য সরকারের কাছে প্রচুর টাকা পেয়েছিলেন, সেই সময়ের সিপিএম নেতা ও মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে। তখনকার রাজ্যপাল বীরেন জে শাহ ওই হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তিনি নিজেও মুম্বইয়ের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।
এই নরেশ আগরওয়ালরা চার ভাই। তাঁরাও বিজনেসম্যান বলে পরিচিত। কিন্তু এঁরা কেউই নরেশ আগরওয়ালের মত কেউকেটা নন। তিনি আলিপুরের বিশাল প্রাসাদের বাসিন্দা। পুরুলিয়া, আসানসোলের কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গেও তাঁর মাখামাখির কথা শোনা যায়।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় কেটে সাত তারা বেআইনি রিসর্ট বানাতে গিয়ে জেলা প্রশাসনের পুরো মদত পেতে অসুবিধা হয়নি নরেশের। অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় নরেশ আগরওয়ালের ওই পাঁচতারা রিসর্টের নাম “সুফল পল্লী”। প্রথমে সেখানেই হয় রসিকা আর কৌশলের বিয়ে। এরপর স্বপ্নের বিয়ের আসর বসেছিল রাজস্থানের উমেদ ভবন প্যালেসে। যেখানে বিয়ে হয়েছিল মার্কিন পপ তারকা নিক জোনাসের সঙ্গে ভারতীয় অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার।
বিয়ের প্রথম এক বছর পর থেকেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। অশান্তি চরমে ওঠে। রসিকা বিষয়টি তার অভিভাবকদের জানিয়েছিলেন।রসিকা মৃত্যুর আগে তাঁর বাবাকে বলেছিলেন , “আর অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না , আমাকে নিয়ে যাও।” সামাজিক সম্মান বজায় রাখার জন্য মেয়েকে ‘মানিয়ে নেওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন রসিকার পরিবার। তাই এখন রসিকার বাবার আফসোস । তিনি বারবার সকলকে বলছেন, আপনার মেয়ে যদি কমপ্লেন করে বাবা শ্বশুর বাড়ির লোক অত্যাচার করছে। বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। তাহলে এক মুহূর্ত দেরি করবেন না। সমাজ সংস্কার ইত্যাদির কথা ভেবে আমরা পিছিয়ে যাই, আপনি অত্যাচারের কথা জেনেও মানিয়ে নেওয়ার কথা বললে নিজের মেয়েটাকে হারাবেন।
বৃহস্পতিবার মৃতা রসিকা আগারওয়ালের বাবা, মা, ভাই সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করলেন, বিচার চাই। অভিযুক্তদের গ্রেফতার চান তাঁরা। বারে বারে কীভাবে রসিকার ওপরে আগরওয়াল পরিবার অত্যাচার করত সে কথা তাঁরা বলেছেন। আলিপুর থানা ও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে অভিযোগ করেও কোনও ফল হয়নি বলে ক্ষোভের কথা জানান ওঁরা। রসিকার মোবাইল, ল্যাপটপ কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। অভিযুক্ত নরেশ আগরওয়াল নাকি কোথায় আছে, পুলিশ তা এখনও জানে না। পুলিশের একটা প্রভাবশালী মহলের মতে, রসিকা “অবসাদ” নামে মানসিক অসুখে ভুগছিল ।অনেক উঁচু থেকে পড়ে গিয়েই তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ আগরওয়ালদের বাঁচাতে যতটা তৎপর, একটি মেয়ের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তার বিন্দুমাত্র দেখা যাচ্ছে না বলে রসিকার পরিবারের অভিযোগ। কলকাতা পুলিশের কর্তারা এখন এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নরেশ আগরওয়ালের সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ওপর মহলের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে। অভিযোগ, প্রভাবশালী যোগাযোগের ফলেই কলকাতা পুলিশ এই মৃত্যুর তদন্তের কাজে ঢিলে দিয়েছে। ৮ মার্চ “আন্তর্জাতিক নারী দিবস”। তাঁর আগেই কি রসিকা মৃত্যু রহস্যের কিনারা করতে পারবেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা?