দেবদাস কুণ্ডু
কতো লেখক কতো শিল্পী
এঁকেছেন মানুষের ছবি
গঙ্গা অজুর্ন বিবর
আমি দেখেছি মানুষ সুন্দর।
শীতের ভোর। গান গাইছেন প্রফুল্লবালা।
রাই জাগো গো জাগো
শ্যামের মন মোহিনী
বিনোদিনী রাই
জেগে দেখো আর তো নিশি নাই
শ্যাম অঙ্গে অঙ্গ দিলাম
আছো রাধে ঘুমাইয়া
কুল কলঙ্কের ভয় নাই গো
জয় রাধে
আমি তোমার সেবার দাসী
যুগল চরণ ভালোবাসি গো
জয় রাধে
জাগো রাধে শ্যামের মনমোহিনী
বিনোদিনী রাই
আধো ঘুম আধো জাগরনে আমার কানে আসছিল সুর। অপূর্ব শব্দ। সুর তাল লয়ে শীতের সকাল বিমোহিত করে তুলেছেন। শুয়ে শুয়ে শুনি প্রতিদিন ঠাকুরমার ভোরাই। এরপর চা আর রুটি নিয়ে আসবে আমার ঘরে।
এই বাড়িটা বাবা ঠাকুমার নামে কিনেছেন। নিজের নামে তো কিনতে পারতেন। কেন কিনলেন না? ওপার বাংলায় হারিয়েছেন নিজের বাবাকে। এক বোন ছিল। জলে ডুবে মারা গেছে। সাঁতার জানতো। সাঁতার জানা মানুষ জলে ডুবে মারা যায়? তখন চারপাশ অস্থির। ধর্মে ধর্মে চলছে যুদ্ধ। হিন্দু নারীর কোন নিরাপত্তা নেই। ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সব হারিয়ে চলে এলেন এই বাংলায় একমাত্র ছেলেকে নিয়ে।
তারপর শুরু নতুন লড়াই। আত্মীয় স্বজন থাকলেও নেই। বাবা প্রায় অর্জুনের মতো লড়াই করে চলেছেন। ডেকোরেশনের ব্যবসা। এই বাড়িতে আইসক্রিম কারখানায় ফ্ল্যাট করেছেন। নি:স্ব মাকে দিয়েছেন এই বাড়ি। কারণ ছেলের সঙ্গে তিনি কৃষ্ণের ভূমিকা পালন করেছেন।
‘এতো সকালে ঘুম ভাঙাও কেন তুমি? জানো তো কত রাত জেগে পড়াশোনা করি। তুমি তো সন্ধ্যা হলেই শুয়ে পড়ো।’
‘আগে বলতো এই গান তোর কেমন লাগে’?
‘দারুণ লাগে। ইচ্ছে করে তোমার সংগে গাই।’
‘ছোটবেলায় তো গাইতিস।’
তাই!
‘আমার পাশে শোবার জন্য তোরা দুভাই মারপিট করতিস।’
‘দাদা কবে আসবে?’
‘কি জানি। গেছে বিদেশে পড়াশুনা করতে।’
‘কেরালা বিদেশ নয়।’
‘দেশ তো আমার এখন নাই।’
‘কে বলেছে তোমার দেশ নেই?’
‘ছিল। জন্ম হলো। ছোটো থেকে বড় হলাম। বারো বছর বয়স বিয়ে দিয়ে দিল। দুটো সন্তান হলো। বাবাকে হারালাম। দাঙ্গার সময় কারা মেরে ফেলল কে জানে? তারপর গেল স্বামী। তিন দিনের জ্বরে মারা গেল। মেয়েটাকে ওরা তুলে নিয়ে গেল। নিজের দেশ হয়ে গেল অচেনা জন্মভূমি ছেড়ে বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে চলে এলাম। ঠাকুমার চোখে জল।
‘এরপরও তোমার এতো কৃষ্ণপ্রেম কেন?’
‘গোবিন্দ ছাড়া এই সংসারে কে আছে?’
‘কেন বি আর এস ফ্ল্যাটে তোমার ছেলে, ছেলের বউ, আমরা দু নাতি। আর কাকে চাও তুমি?
‘তোরা আছিস। থাকবি। কিন্তু এই জীবন গোবিন্দের।’
‘তুমি আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছো। বর্ণ পরিচয় তোমার হাতে শিখি। তুমি স্কুলে ভর্তি করে দাও। কোন আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, তার বিয়ের ব্যবস্থা করো। কিন্তু সেদিন তো কোন আত্মীয় সাহায্য করেনি।’
‘গোবিন্দ করেছে। এই যে বেঁচে আছি গোবিন্দের দয়ায়। তিনি যেদিন ডাক দেবেন, চলে যাবো।’
কী আশ্চর্য। পরদিন ভোরে গান হচ্ছে না। কি ব্যাপার? গেলাম ঠাকুমার ঘরে। তিনি বসে আছেন গোবিন্দের কাছে। একমনে, এক চোখে দেখছেন তার ঈশ্বরকে।
‘ঠাকুমা’
কোন সাড়া নেই।
‘ঠাকুমা’
এবারও সাড়া নেই। গায়ে হাত দিতে শুয়ে পড়লেন। কী আশ্চর্য এভাবে কারো মৃত্যু হয়? আমি কাঁদতে পারছিলাম না। অসীম ভালোবাসার দিঘিটা মরে গেল! এতো বড়ো হয়েও ঠাকুমার কোলে শুতাম মাঝে মাঝে।
মনীষা অভিমান করে বলে, ‘ঠাকুমা আমার সতীন।’
মনীষা কাঁদছে। ওকে ভালোবাসতো ঠাকুমা। আমার ঘরে এলে ঠাকুমা ওকে আদর করতো। ও কাঁদছে। আমি কেন পারছি না? তবে কি আমি মেনে নিতে পারছি না, ঠাকুমা নেই!