লোকসভা ভোটে বাংলায় রীতিমত পর্যুদস্ত বিজেপি। যাবতীয় হিসেব-নিকেশকে নস্যাৎ ২৯টি আসনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যদিকে, মাত্র ১২টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। এই ভোটের ফলাফল একদিকে যেমন তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে, তেমনই রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বলতে গেলে, অভিষেকের সঙ্গে লড়াইয়ে নক-আউট হয়ে গেলেন শুভেন্দু।
সন্দেশখালির ঘটনা, শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিকে সামনে রেখে ভোট ময়দানে তৃণমূলের মোকাবিলায় নেমেছিল বিজেপি। কিন্তু তা যে খুব একটা কাজে আসেনি, তা ফলাফলেই স্পষ্ট। দক্ষিণবঙ্গে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে পদ্মফুল। দক্ষিণবঙ্গের ৩৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৬টি। এগুলি হল, রানাঘাট, বিষ্ণুপুর, বনগাঁ, তমলুক, কাঁথি এবং হারতে হয়েছে দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে।
অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গে ৮টি মধ্যে গতবার ৭টি দখল করেছিল গেরুয়া শিবির। এবার সেখানে তারা পেয়েছে ৬টি আসন। হেরেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক।
কেন বিজেপির এই শোচনীয় ফল? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মমতা ব্যানার্জির সাফল্যের পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ। এর মধ্যে, অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হল, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেইসঙ্গে রয়েছে, মহিলা ও সংখ্যালঘু ভোট । সিএএ-র কারণে মতুয়া ভোটারদের একটা বড় অংশ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন।
পাশাপাশি, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ৭৭টি আসন পেলেও, দলের সংগঠনকে মজবুত করতে ব্যর্থ হয়েছেন রাজ্য বিজেপির নেতারা। তার ছাপ পড়েছে লোকসভার ফলাফলে। দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে কোন্দলেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। দলের যা কিছু তৎপরতা, তা সমাজ মাধ্যম এবং মিডিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঠে নেমে সক্রিয় কোনও আন্দোলন করতে দেখা যায়নি এই রাজ্যের নেতাদের।
এই ভরাডুবির জন্য শুভেন্দুর দিকেই আঙুল তুলেছেন বিজেপি নেতাদের একাংশ। এবারের ভোটে শুভেন্দু অধিকারীর ওপর ব্যাপক আস্থা রেখেছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বারবার দিল্লিতে ডেকে বৈঠক করা থেকে শুরু করে প্রার্থী বাছাই, সবক্ষেত্রেই শুভেন্দুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকি রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মতামতকেও শুভেন্দুর মতো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে প্রায় ৩৫টিতেই টিকিট দেওয়া হয়েছে শুভেন্দুর পছন্দের প্রার্থীদের।
দিলীপ ঘোষ যে শুভেন্দুর পছন্দের নেতা নন, তা শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, গোটা রাজ্যের মানুষ জানেন। তাই দিলীপকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তাঁদের কেন্দ্রই বদলে দিলেন শুভেন্দু। গত লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুরে প্রায় ৮৯ হাজার ভোটে জিতেছিলেন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি। এবার তাঁকে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন, যেখানে গতবার মাত্র আড়াই হাজার ভোটে জিতেছিলেন এস এস আলুওয়ালিয়া। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিয়ে দুর্গাপুরে প্রার্থী পদের বিরোধিতা করেননি দিলীপ। অন্যদিকে, শুভেন্দুর ইচ্ছাতেই দিলীপের মেদিনীপুর আসনে প্রার্থী করা হয় অগ্নিমিত্রা পালকে। আর আলুওয়ালিয়াকে প্রার্থী করা হয় আসানসোলে। তিনটি আসনেই বিজেপি প্রার্থীরা হেরেছেন। অর্থাৎ শুভেন্দুর একগুঁয়েমিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দুটি জয়ী আসনে হার স্বীকার করতে হয়েছে বিজেপিকে।
শুভেন্দুর কথামতোই বর্ধমান পূর্বে অসীম সরকার, ঘাটালে হিরণ চট্টোপাধ্যায়, বারাসতে স্বপন মজুমদার এবং মুর্শিদাবাদে গৌরীশঙ্কর ঘোষকে দাঁড় করানো হয়েছিল। এই সবকটি আসনেই হেরেছে বিজেপি।
রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের একাংশের মতে, ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে দিলীপকে হারানোর জন্যই তাঁর কেন্দ্র বদল করেছেন শুভেন্দু। এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ দিলীপের অনুগামী ‘আদি’ বিজেপির নেতারা। তাঁদের মতে, ২০১৯-এ দিলীপের নেতৃত্বেই ১৮টি আসনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপের গুরুত্বকে খাটো চোখে দেখেছেন বলে তাঁদের অভিযোগ। শুধু তাই নয়, যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেন্দু বারবার নিশানা করেছেন, তিনি ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে জয়ী হয়ে বিরোধী দলনেতার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন।
এই লোকসভা নির্বাচনের ফল রাজ্যে শুভেন্দুর নেতৃত্বকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। সেইসঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। সন্দেশখালিকে সামনে রেখে বাজিমাত করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু বসিরহাট কেন্দ্রেই পর্যুদস্ত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র। সেখানে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন তৃণমূলের হাজি নুরুল ইসলাম। শুভেন্দু ভেবেছিলেন, এই লোকসভার নির্বাচনের পর রাজ্য রাজনীতিতে তিনিই বিজেপির প্রধান মুখ হয়ে উঠবেন না। কিন্তু ভোটের ফলে তাঁর মুখ পুড়েছে।