শুভদীপ রায় চৌধুরী
দেবী দশভুজার আরাধনা প্রায় এসেই গেল। বাংলার বিভিন্ন ঠাকুরদালানের প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্বে। দেবীর রূপের বৈচিত্র্য দেখা যায় বিভিন্ন বনেদি বাড়িতে, অর্থাৎ সব পরিবারে কিন্তু দেবী সিংহবাহিনী দশভুজা নন, বহু বাড়িতে তিনি অভয়ারূপে দ্বিভূজা এবং শিবের ক্রোড়ে অধিষ্ঠান করেন। ঠিক এমনই এক বনেদিবাড়ি হল উত্তর কলকাতার চন্দ্রবাড়ি। এই বাড়িতে দেবী পূজিত হন মহিষাসুর ছাড়াই, অর্থাৎ দেবী এখানে মহাদেবের কোলে বসে আছেন। আর সঙ্গে রয়েছে তাঁর চার সন্তান। এইভাবেই পুজো (Durga Pujo) হয়ে আসছে উত্তর কলকাতার চন্দ্র বাড়িতে।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি থেকে একটু এগোলেই মিলবে এই চন্দ্র বাড়ি। চন্দ্র পরিবারের পুজো শুরু হয়েছিল সপ্তগ্রামের আদিবাড়িতে। তারপর তাঁরা ব্রজদুলাল স্ট্রিটে থাকাকালীন পুজো করতেন। কলকাতায় আসার পর রামপ্রসাদ চন্দ্র, সনাতন চন্দ্র এবং উদয়চাঁদ চন্দ্র পুজো করতেন। এই পরিবারের পৈতৃক ব্যবসা ছিল সোনার, তাই অর্থের কোনদিনই অভাব ছিল না। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ শ্রীনাথ চন্দ্রের সময় তাদের আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়। সিপাহী বিদ্রোহের বছর সাতেক আগে, ১৮৫০ সালে মহাসমারোহে দুর্গাপুজো শুরু করেন তিনি। শুভ কাজের সূচনায় তিনি দেবীকে একটি মোহর দিয়েছিলেনং সেই মোহর আজও চন্দ্র বাড়িতে রয়েছে এবং প্রতিবছর দেবীকে সেটি দেওয়া হয়।
উল্টোরথের দিন কাঠামোপুজো, তারপর মূর্তি তৈরি শুরু হয় চন্দ্রবাড়ির ঠাকুরদালানে। এই বাড়িতে দেবী মহাদেবের কোলে বসেন অর্থাৎ হরগৌরী রূপে আরাধনা হয়। দুইপাশে থাকেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ। সিংহাসনে থাকেন জয়া এবং বিজয়া। এই বাড়ির প্রতিমার চালচিত্রে দশ মহাবিদ্যা এবং দেবীর মহিষমর্দিনীর ছবি অঙ্কিত থাকে। গণেশের খড়ম, শিবের খড়ম, দেবীর মুকুট সবই সোনা বা রুপোর। মহালয়ার পরদিন থেকে ঘট বসানো হয়। সেই থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীর দিন বোধন বসে চন্দ্রবাড়িতে।
এই পরিবারের কুলদেবতা হলেন শ্রীসীতানাথ জিউ এবং ধান্যলক্ষ্মীদেবী। তাঁরাও পুজোর সময় ঠাকুরদালানে উপস্থিত থাকেন। পুজো শেষ হলে কুলদেবতাকে উপরে তুলে দেওয়া হয়। আবার পরের দিন পুজো শুরুর আগে নিয়ে আসা হয়। সপ্তমীর দিন কলাবউ স্নান করানোর পর বাড়িতে এসে সপ্ততীর্থের জল দিয়ে আবার স্নান করানো হয়। এরপর হয় দেবীর চক্ষুদান এবং মূলপূজা।
চন্দ্রবাড়িতে সপ্তমীর দিন হোমের আগুন জ্বালানো হয় এবং মহানবমীর দিন আরতির পর হোমকুণ্ডের আগুন নেভানো হয়। পুজোর সময় সেই আগুন নেভানো হয় না। দেবীর পায়ের কাছে চন্দ্র পরিবারের পক্ষ থেকে বিরাট একটি সিঁদুরের বাক্স রাখা হয়। ১৮৫০সাল থেকে এই বাড়িতে যত বিয়ে হয়েছে, তাঁদের সবার একটি করে সিঁদুর কৌটো এই বাক্সটিতে রাখা হয়।
মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপূজার পর ধুনো পোড়ানোর রীতি আছে এবং সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে পুজো হয় বলে বলিদানের প্রথা নেই। বলিদানের বদলে এই বাড়িতে মাশকলাই সিঁদুরে মাখিয়ে দেবীকে অর্পণ করা হয়।
পুজোর সময় মেয়েদের নাকে নথ এবং পায়ে মল পড়া বাধ্যতামূলক। পুজোর সময় বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে নানান রকমের মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়। যেমন লুচি, নারকেল নাড়ু, রসবড়া, চন্দ্রপুলি, গজা, নিমকি ইত্যাদি। প্রতিদিন ১৭টি থালায় চাল, কলা এবং মিষ্টি দিয়ে ঠাকুরকে নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরকে আরতির পর দুধ ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।
চন্দ্রবাড়িতে পুজো শেষের পর প্রথম পুরোহিতকে দক্ষিণা দেওয়া হয় ১৭৪৯ সালের একটি রুপোর কয়েন দিয়ে। ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে এই প্রতীকী দক্ষিণা দেওয়ার পর মুদ্রাটি ফেরত নিয়ে বর্তমান মূল্য দেওয়া হয়। দশমীর দিন দেবীবরণের পর কনকাঞ্জলি প্রথাও রয়েছে এই বাড়িতে। মহালয়ার দিন থেকে এই পরিবারে মাছ খাওয়া নিষেধ এবং দশমীর দিন বিসর্জনের পর মাছ কিনে খেতে হয় পরিবারের সদস্যদের। এইভাবে ঐতিহ্যের সাথে আজও পুজো করে আসছেন চন্দ্রবাড়ির সদস্যরা।