হোমPlot1কিংবদন্তি সঙ্গীত সাধক, খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠান, মাত্র ৩৬ বছরেই অকাল প্রয়াণ

কিংবদন্তি সঙ্গীত সাধক, খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠান, মাত্র ৩৬ বছরেই অকাল প্রয়াণ

কিংবদন্তি সঙ্গীত সাধক, খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠান, মাত্র ৩৬ বছরেই অকাল প্রয়াণ

ডঃ শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
এক সময় দেবী কালীর পুজো ছিল একান্তভাবেই তান্ত্রিকদের। পরে জমিদার বাড়িতেও আরাধনা হতো দেবীর। আজ অবশ্য মা কালীর পুজো হয় বাংলার সর্বত্র। এই কালীপুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে “আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল”, “অপার সংসার নাহি পারাপার”, “চাই না মাগো রাজা হতে”-র মতো কালজয়ী শ্যামা সঙ্গীত। আর শ্যামা সঙ্গীত বললেই, আজও যার নাম ভেসে ওঠে, তিনি হলেন সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য।পঞ্চাশের দশকের পর কে মল্লিক, ভবানী দাস, মৃণাল কান্তি ঘোষের পর বাংলা ভক্তিগীতি ঐশ্বর্য পর্বে পৌঁছেছিল যাঁর আবেগমথিত, সারল্যমণ্ডিত কণ্ঠে – তিনি পান্নালাল ভট্টাচার্য। শ্যামা সঙ্গীতের মাতৃ বন্দনা ধারায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। নিজের সময়ের বৃত্তে দাঁড়িয়েই হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।

সঙ্গীত আর সাধনা ছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যের রক্তে। এঁরা ছিলেন ভাদুড়ী। বর্ধমান মহারাজার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ভট্টাচার্য উপাধি। পান্নালাল ভট্টাচার্যের পিতা সুরেন্দ্রনাথ, ভাদুড়ী হলেও এই কারণেই তিনি ভট্টাচার্য ব্যবহার করতেন। হাওড়ার পায়রাটুঙির জমিদারি ছেড়ে এক সময় সন্ন্যাস নিতে চেয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্রনাথের মতোই একসময় জমিদারি ছেড়ে যোগ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাঁর কাকা – “The Levitating Saint” হিসেবে যিনি পৃথিবী বিখ্যাত, সেই যোগাচার্য ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ।

পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পথ ধরে সংসার ছেড়েছিলেন তাঁর ভাইপো ননীলাল ভাদুড়ীও, পরবর্তীকালের যোগ-ভক্তি মার্গের সিদ্ধসাধক ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী। কিন্তু সাঁতরাগাছির কুলগুরুর নির্দেশে সুরেন্দ্রনাথ বিয়ে করেন অন্নপূর্ণা দেবীকে। এঁদেরই তিন পুত্র বাংলা সঙ্গীতের তিন কিংবদন্তি – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য।

পান্নালাল ভট্টাচার্য যখন মাতৃগর্ভে তখন হঠাৎই প্রয়াত হন সুরেন্দ্রনাথ। তারপর পান্নালাল ভট্টাচার্যকে পিতার স্নেহ এবং শাসনে পালন করেন তাঁর দুই দাদা – সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য এবং স্বর্ণকণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যই।

পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ থেকে ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী কিংবা সুরেন্দ্রনাথ – সঙ্গীতে আশ্চর্য পারদর্শিতা ছিল এঁদের। পান্নালাল ভট্টাচার্যের মধ্যে সেই প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথাতে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য পান্নালালকে  মেগাফোনের জেএন ঘোষের কাছে নিয়ে যান। এই দুই দাদার অনুপ্রেরণাতেই পান্নালাল ভট্টাচার্য ভক্তিগীতি গাইতে থাকেন।

আজও কালী পুজো পর্ব এলেই শ্যামা সঙ্গীতে জীবন্ত হয়ে উঠেন পান্নালাল। চলে যাওয়ার এতো বছর পরেও এই পর্বে জীবন্ত হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু কেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে প্রথমে তাঁর জীবনে, পরে সঙ্গীতে। এক অদ্ভূত নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতা প্রতিমুহূর্তে ঘিরে থেকেছে তাঁকে। পারিবারিক পরিবেশে তিনি দেখেছেন বৈধী ভক্তির ধারা। পরবর্তীকালে তিনি নিজেও প্রবেশ করেছেন মানসিক-আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জগতে। বালি বারেন্দ্রপাড়ায় নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করেছেন মায়ের প্রতিমা। নিত্য পুজো করেছেন মা দক্ষিণাকালীর।

তারপর প্রবেশ করেছেন ধীরে ধীরে মানস পুজোয়। অনুভব করেছেন – দেহ আসলে দেবালয়, সেখানেই প্রতিষ্ঠা সদাশিবের: “দেহো দেবালয়ো দেবি জীবো দেবঃ সদাশিবঃ”। গঙ্গার ঘাটে, শ্মশানে বসে তিনি অন্তর্যাগে-পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন। প্রথাগত দীক্ষা নয়, তাঁর দীক্ষা হয়েছে চিন্তা সূত্রে। জীবন ও জীবন সাধনার এই ক্রমই তাঁর সংগীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি পৌঁছে গিয়েছেন শ্যামা সঙ্গীতের মর্মে। অথচ পুরোটাই ঘটেছে সবার চোখের আড়ালে। সবাই দেখেছেন তাঁর দু’চোখে বিষণ্ণতা, সঙ্গীতেও সবাই খুঁজে পেয়েছেন সেই বিষণ্ণতার ছাপ। কিন্তু নীরব সাধকের এই ভেতরের পরিবর্তন কেউ সেভাবে বোঝেন নি।

জীবনের শেষ পর্বে তিনি সরে গিয়েছেন সবকিছু থেকে। খ্যাতির শীর্ষে থেকেও বাতিল করেছেন একের পর এক অনুষ্ঠান। ফুটবল খেলার মাঠে আর তাঁকে সেভাবে দেখা যায়নি দর্শক হিসেবে। আধুনিক গান গাওয়া, সিনেমায় অভিনয় করা কিংবা সিনেমা প্রযোজনা করার প্রবল ইচ্ছা থেকে তখন তিনি শত হস্ত দূরে। শোক, দ্বেষ, আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই ধীরে ধীরে তাঁর কাছে মনে হয়েছে অর্থহীন। একেই বলে ভক্তির পরম প্রকাশ :
” যতপ্রাপ্য না কিঞ্চিদ্বাঞ্ছতি ন শোচতি ন দ্বেষ্টি।
ন রমতে নোৎসাহী ভবতি।।”
এই অবস্থানই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য জগতে। তিনি হয়ে উঠেছেন সংসারে সন্ন্যাসী। তিন কন্যা সন্তানের এই পিতার কাছে তখন সর্বস্ব – শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির পদপ্রান্তে বসে কৃপা ভিক্ষা আর মায়ের নাম। লোকের আড়ালে মুখে আর লোকের সামনে ভেতরে। মা ভবতারিণীর দর্শন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সে এক আশ্চর্য আকুতি।

তাঁর এই আচরণ স্বাভাবিকভাবেই অচেনা লেগেছে খুব কাছের মানুষদেরও। ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে অনেক। তৈরি হচ্ছে হয়েছে সম্ভাব্য ঘিরে নানান জল্পনা। কিন্তু জাগতিক সেসব – তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং আরও বেশি করে পুঞ্জীভূত হয়েছে অভিমান। মা ভবতারিণীকে প্রত্যক্ষে না দেখতে পারার সেই অভিমানই প্রস্তুত করেছে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে চির বিদায়ের প্রেক্ষাপট। 

মায়ের এই অভিমানী সন্তান বুঝতেই পারেননি মা বিরাজ করছেন অন্তরে – তাঁর হৃদিপদ্মে আর বাইরে তাঁরই কণ্ঠ সঙ্গীতে। তাই আজও বাঙালির মাতৃ বন্দনার শ্যামা সঙ্গীত মানে পান্নালাল ভট্টাচার্য। তিনিই বাঙালির শ্যামা সঙ্গীতের সর্বস্ব।

(লেখক সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের অগ্রজ সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের দৌহিত্র।)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img