হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিশিক্ষা থেকে সমাজ সংস্কার, এক মহামানবের একক লড়াই

শিক্ষা থেকে সমাজ সংস্কার, এক মহামানবের একক লড়াই

শিক্ষা থেকে সমাজ সংস্কার, এক মহামানবের একক লড়াই

sandip atcসন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতের শিক্ষা ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বুদ্ধিবৃত্তির অভাব এবং কুসংস্কারের অন্ধকারের মধ্যে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব; তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে শুধুমাত্র তাঁর আদর্শগুলিকেই তুলে ধরেননি, বরং তিনি সেই সময়ের সমস্যাগুলিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করেছিলেন এবং সেগুলির প্রতিকার সম্পর্কেও তাঁর সম্যক ধারণা ছিল।

বিদ্যাসাগর সম্ভবত তাঁর প্রজন্মের প্রথম ব্যক্তি যিনি শিক্ষাকে সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই তৎকালীন সমাজের যাবতীয় অন্ধকার দূর করতে পারে। আর সেই বোধের উপর ভিত্তি করেই নিরক্ষরতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ দেশবাসীদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে বিদ্যাসাগর আজীবন কঠোর পরিশ্রম করে গিয়েছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক প্রয়োগবাদী শিক্ষাবিদ, যিনি ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা-প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়েছিলেন। নীতি নির্ধারক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে মত বিনিময়ের সুযোগ তাঁর ছিল। যদিও, তা যে সবসময় তাঁর জন্য খুব সহজসাধ্য ছিল এমন নয়। পাবলিক ইন্সট্রাকশন ডিরেক্টর গর্ডন ইয়ং-এর সঙ্গে একাধিক বার তাঁর নানা বিষয়ে মতবিরোধ হয়।

কিন্তু তিনি কখনোই সরকারি ব্যবস্থার কাছে পুরোপুরি নতি স্বীকার করেননি। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে নিজের জায়গায় তিনি ছিলেন দৃঢ় ও অবিচল, যা কিনা যে-কোনো শিক্ষা-প্রশাসকের কাছে আজও এক শিক্ষণীয় বিষয়। শিক্ষার মূল লক্ষ্যের বিরোধী কোনো সরকারি নীতির সামনে কখনোই নতি স্বীকার করা উচিত নয়, এই শিক্ষাই তিনি দিয়ে গেছেন।

বিদ্যাসাগর পশ্চিমি শিক্ষার প্রসারের পক্ষপাতী ছিলেন; তিনি ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি করেন। বিজ্ঞান এবং বস্তুগত দর্শনের সর্বশেষ বিকাশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে রেখে, একজন শিক্ষাবিদ এবং প্রশাসক হিসেবে তাঁর এই দাবি ছিল যথেষ্টই যুক্তিসঙ্গত। সময়ের দাবি মেনে, প্রচলিত রক্ষণশীলতাকে প্রতিহত করাই যে-কোনো দূরদর্শী প্রশাসকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এবং বিদ্যাসাগরও ঠিক তেমনটাই করেছিলেন।

নৈতিকতার শিক্ষাকেই তিনি সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করেন। কারণ তাঁর দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল আমাদের সমাজের নীতিবোধের আসন্ন বিপন্নতা। বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন, শিক্ষিত মানুষের নৈতিক অবনমন আদপে শিক্ষাগত উন্নয়নের কোনো নীতিকেই কার্যকর করতে পারে না। আর একারণেই তিনি আধুনিক। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক কাঠামোর অবক্ষয় আজ বিশ্বজুড়ে।

প্রশাসনিক সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগর এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি সংস্কৃত কলেজের দরজা জাতি, ধর্ম বা ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য খুলে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকল সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাক। তাই যে-কোনো যুগেই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। বহুকাল আগে বিদ্যাসাগরের এই যে বহুত্ববাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়ে গেছেন, তা যেন আজও এই প্রজন্মের শিক্ষা-প্রশাসকদের দিশা দেখায়।

একজন প্রশাসক হিসাবে বিদ্যাসাগর প্রথাগত শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে ছিলেন, বরং তাঁর পছন্দ ছিল আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষা। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের উডের ডেসপ্যাচের ক্ষেত্রে তাঁর দেওয়া মতামতগুলি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে এক গুরুতর বিতর্কের সূচনা করে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যাসাগর ইংরেজিকে স্বীকার করে নিলেও কমিটিকে তিনি দৃঢ় ভাবে বুঝিয়েছিলেন যে, আঞ্চলিক ভাষাকে কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না।

আর তাঁর এই অবিচল সিদ্ধান্তের কারণেই উডের ডেসপ্যাচে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাপ্রদানের সুপারিশ বহাল ছিল। মনে রাখা দরকার, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নারীশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সহায়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা প্রভৃতি এই কমিটির প্রধান সুপারিশগুলি আসলে বিদ্যাসাগরেরই চিন্তার ফসল। সমসাময়িক শিক্ষাভাবনার ক্ষেত্রেও শিক্ষাকাঠামোয় এই সমস্ত বিষয়গুলিকে এখনও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে।

শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সেইসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তাঁকে যে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা প্রায় কল্পনাতীত। আজ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার নিয়মনীতিগুলির তুলনা করতে গিয়ে দেখি বিদ্যাসাগরের কাছে আমরা চিরঋণী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভরতির ফি এবং টিউশন ফি গ্রহণের বিষয়ে তিনিই প্রথম উদ্যোগী হন।

ক্লাসে উপস্থিতি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিময়নিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। মে-জুন মাসের প্রচণ্ড গরমের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রচলনও তিনিই করেন। শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়ের অনুসরণের জন্য বিদ্যাসাগর প্রদর্শিত এই শৃঙ্খলাবোধ, যে-কোনো শিক্ষা-প্রশাসককেই সঠিক পথের দিশা দেখায়। একইসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে, একজন প্রশাসককে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যথা হয়নি।

ন্যায়ের পথে চলার সৎসাহস তাঁর ছিল এবং যিনিই শিক্ষা-প্রশাসনের তত্ত্বাবধান করবেন, তাঁকেই তাই করতে হবে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায়ও পাঠের পাশাপাশি ব্যাবহারিক প্রদর্শনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই শিক্ষার পদ্ধতিতে তথ্য-সংযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আজ আমরা শিশুর শিক্ষার পরিণতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি।

বিদ্যাসাগর অনেকদিন আগেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন এবং তাই সিলেবাস কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি স্থানীয় ভাষা শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। আর এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। নিজের লেখা বইকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাঁর সেই সমালোচকরা ভুল ছিলেন।

১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইংরেজ কবি ম্যাথু আর্নল্ড, যিনি কিনা একজন স্কুল পরিদর্শকও ছিলেন, ইংল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষার মান সম্পর্কে তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন। সমসাময়িক ভারতে বিদ্যাসাগর গণশিক্ষার লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাঠশালার উন্নতির বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফ্রেডরিক হ্যালিডেকে একটি চিঠি লিখেছিলেন।

শিক্ষার প্রক্রিয়া অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিদ্যাসাগর মাসিক পরীক্ষার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। প্রাথমিকভাবে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত। আধুনিক শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের ক্রমোন্নতির জন্য পুনরাবৃত্তিমূলক মূল্যায়ন পদ্ধতির উপর নির্ভর করেন। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তার উদ্দেশ্যে বর্তমানে ‘কন্যাশ্রী’, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রভৃতি সরকারি প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অত বছর আগে একই উদ্দেশ্য নিয়ে একজন শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে বিদ্যাসাগর ‘নারীশিক্ষা ভাণ্ডার’ গঠনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

একজন প্রশাসককে একটি ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাঁকে হতে হবে সাহসী, সহানুভূতিশীল, উদ্ভাবনী শক্তি এবং সামগ্রিক ভাবনার অধিকারী। বিদ্যাসাগরের মধ্যে এই সব কটি গুণ ছিল। তাই এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে আজ তাঁর জন্ম দ্বিশতবার্ষিকীতেও তিনি আমাদের কাছে একইরকমভাবে সমসাময়িক। তবে শুধুমাত্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালনের মধ্যে বিষয়টিকে সীমায়িত না রেখে আমরা যদি আমাদের বাস্তবজীবনে এবং কাজে তাঁর প্রদর্শিত আদর্শ ও নীতিগুলির প্রয়োগ করি, তবে তা-ই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। 

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img