হোমঅন্যান্যঅবসাদে আত্মঘাতী সুশান্ত সিং রাজপুতের স্মৃতিতে এক অবসাদগ্রস্তের আত্মপ্রলাপ

অবসাদে আত্মঘাতী সুশান্ত সিং রাজপুতের স্মৃতিতে এক অবসাদগ্রস্তের আত্মপ্রলাপ

অবসাদে আত্মঘাতী সুশান্ত সিং রাজপুতের স্মৃতিতে এক অবসাদগ্রস্তের আত্মপ্রলাপ

উত্তাল ঘোষ: চৌত্রিশ বছরের সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মঘাতী হয়েছেন। কারণ অবসাদ (depression)। ফেসবুকে নানা লেখা দেখছি। নানা জায়গায় অনেক কথা শুনছি। সব অবসাদকে ঘিরে। সে সব কথা যে আন্তরিক তাতে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।

আমি নিজে বছর পাঁচেক এই রোগে গুরুতর ভাবে কাহিল ছিলাম। হাসপাতালেও ভর্তি থাকতে হয়েছে। তাই কিছুটা ধারণা হয়েছে এই রোগটা সম্পর্কে। ধারণা হয়েছে আত্মহত্যার ভাবনা সম্পর্কে। কত রাত লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে ট্রেন ধাক্কা মেরেছে। ছিটকে পরেছে আমার রক্তাক্ত, থেঁতলানো শরীরটা। চিন্তাটা সরাতে চেয়েছি। পারিনি। বাঁচার তীব্র আকাঙ্খায় শেষে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আর মনোবিদদের সাহায্যে এখন অনেকটা ভাল। দু’-একদিনের মধ্যেই আবার চেক-আপে যেতে হবে।

আমি মানসিক রোগী শুনে অনেকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে পারেন। অনেকে আন্তরিক ভাবে এসে বলতে পারেন, ভয় কি বন্ধু, আমি তো আছি। আয় একসাথে বাঁচি। দুঃখের সঙ্গে বলছি, কোনওটাই আমাকে সুস্থ হতে সাহায্য করবে না। দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত এই ডিপ্রেশন রোগে। কেন?

আমার কথাগুলো ডিপ্রেশনের রুগীদের জন্য নয়। এ ভাবে তাঁদের কোনও উপকার করা যায় না। যাঁরা ডিপ্রেশনকে বড়লোকি বায়নাক্কা বা দুঃখবিলাস মনে করেন, ডিপ্রেশন যে একটা অসুখ, সেটা তাঁদের বোঝাতেও কথাগুলো বলছি না। হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় দেখেছি গ্রামের গরীব মানুষের মধ্যে মনোরোগ কতটা ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে।
এর বাইরে সামান্য কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজেদের সর্বজ্ঞ না ভেবে বোঝার চেষ্টা করেন, রোগীকে সত্যিকারের সাহায্য করতে চেষ্টা করেন।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আন্তরিক ভাবে যাঁরা আমাকে সুস্থ করতে চেয়েছেন, তাঁরাও বলতেন, তোমার রোগ তো শরীরে নয়, মনে। মনটা শক্ত করো। মনের জোরে সব হয়। দু পা বাদ গেলেও লোকে তা নিয়ে পাহাড় পেরোয়, সমুদ্র পেরোয়।
কেউ বলতেন, গান শোনো, বই পড়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও, নিজেকে ভাল রাখ, মনটাকে আনন্দে রাখ।

সেই সব আন্তরিক কথাগুলিও তখন বিরক্তিকর, এমনকি সময়ে সময়ে নির্দয় শোনাত। মনে হয়, তাঁরা আমার সমস্যাটা বুঝতেই চাইছেন না। সমস্যার গোড়াটা যে কি, সেটা নিজেই কিন্তু বুঝতে পারতাম না। কখনও মনে হত বাড়ি, কখনও মনে হতো অফিস, কখনও মনে হতো আর্থিক সমস্যা, কখনও মনে হতো স্ত্রী বা ছেলে হল সমস্যার কারণ। সমাধানের রাস্তাও বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝতে পারি এর কোনওটাই রোগের কারণ নয়। কারণ সেই পরিস্থির মধ্যেই (কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও) তুলনামূলক ভাবে ভাল আছি।

চারপাশটা অন্ধকার মনে হচ্ছে না। রং চোখে পড়ছে।
অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, কারণ যে সব সময় খুব স্পষ্ট হবে, তা নয়। তাই সে সব না ভেবে চিকিৎসা করাতে হবে। অহেতুক জ্ঞান দান করে সময় নষ্ট করার চেয়ে রুগীকে ডাক্তার বা থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেখান থেকে রোগটা সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তবেই প্রিয়জনকে সুস্থ করার কাজটা করা যাবে।

ও পারলে তুমি পারবে না কেন, অমুক তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে কিন্তু ও তো তোমার মত হয়ে যায়নি কিংবা পঙ্গুর গিরিলঙ্ঘনের মতো উদাহরণগুলো না দেওয়াই ভাল। কারণ রোগটাই তো সেটা।

ঋতু বদলের সময় ঠান্ডা পরে। তাতে কেউ অসুস্থ হন না, কেউ অল্প হন, কারও অসুস্থতা বাড়াবাড়ি রকমের হয়। ডিপ্রেশনের মতো রোগেরও কারণও তেমন। কোনও পরিস্থিতিতে কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারেন, কেউ অল্প কাতর হন, কেউ হন বাড়াবাড়ি রকমের। আবার এক ব্যক্তি এক সময় স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তীতে তুলনামূলক ভাবে ভাল অবস্থাতেও মানসিক ভাবে বিগড়ে যেতে পারেন।

অসুস্থতার সময় আর্থিক সমস্যা নিয়ে খুব কাতর থাকতাম দেখে আমার এক বন্ধু বলত, রাজনীতি করার সময় আমার কাছ পঞ্চাশ টাকা চেয়ে নিয়ে দিব্যি ডায়মন্ড হারবার চলে যেতে। সেই তুমি টাকার জন্য কাতর হচ্ছ! কথাটা ঠিক। কিন্তু কথাটায় কোনও উপকার হত না। কারণ ওটাই তো রোগ।

ব্যাপারটা মন দিয়ে বুঝে নেওয়ায় ওই বন্ধুই আমাকে সুস্থ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়।
অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ লাগে। অনেক ক্ষেত্রে থেরাপিতেই কাজ হয়। কে কোন পর্যায়ে আছে তা নিজেরা মাপার চেয়ে, আয় বেঁধে বেঁধে থাকি বলে কাব্য করার চেয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যাওয়া, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ করাটা বেশি জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক রোগে নানা শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই সব পরিস্থিতিতে সহায়কের ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিপ্রেশনের রুগীকে দেখে বোঝা যায় না। অন্যরা তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও রুগী সেটা নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রেও সহায়কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

হাসপাতালে থাকতে থাকতে দেখেছি আত্মহত্যার ভাবনাটা আস্তে আস্তে সরে গেছে। কিন্তু হাসপাতালে তো বটেই, বাড়ি আসার পরেও নানা শারীরিক কষ্ট হত। ঘুম হত না। খুব গরম লাগত। ডাক্তারবাবুর গুষ্টির ষষ্টিপুজো করে ছাড়তাম। কিন্তু ওঁদের দেওয়া ওষুধ নিয়মিত খেয়ে গেছি। থেরাপিস্টদের পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করেছে আমার মতো বেয়াদপ লোকও।

একদিন হঠাৎ দেখলাম পাল্টে গেছে সব। শরীরের কষ্টগুলো অনেকটাই চলে গেল, মন অনেক তাজা হয়ে গেল, ঘুম ফিরে এল। তাই বলছি কারণ খোঁজার চেষ্টা না করে, কখন কেন বদল হচ্ছে সে সব ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। সহায়ক হিসেবে অবান্তর কথা না বলে নিজের ভূমিকাটা পালন করাই ভাল।

অনেকে শারীরিক রোগের চেয়ে মনের রোগকে কম গুরুত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা উল্টো।
মনের জোর শারীরিক সমস্যাকে জয় করতে সাহায্য করে। কিন্তু মনের সমস্যা মানে তো মনই দুর্বল হয়ে গেছে। মনের জোর রাখো বলে শারীরিক ভাবে অসুস্থকে সাহায্য করা যায় কিন্তু মানসিক রুগীকে যায় না। মনের জোর না থাকাটাই তো তাঁর রোগ। দয়া করে রুগীকে বলবেন না, মনে আনন্দ আনো। মনে রাখুন, ওটাই রোগ।

অনেকে ভাবেন, সবাই মিলে হইচই করা, সিনেমা দেখা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া-এসব করেই অবসাদ আক্রান্তের মন ভাল করে দেওয়া যাবে। ভুল হয়ে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, মন খারাপ আর অবসাদ, এক জিনিস নয়। যাঁর আনন্দ নেওয়ার ক্ষমতাই কমে গেছে, তাঁকে এ ভাবে আনন্দ দেওয়া যায় না। সেটা না বুঝলে মুশকিল। মনে হবে, আমি তো ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করছি। ও চায় না আনন্দে থাকতে। ওর জন্য আর চেষ্টা করে লাভ নেই। ব্যাপারটা যেন জল খেয়ে জলাতঙ্ক সারানোর মত না হয়ে যায়।

যাঁরা মেজর ডিপ্রেশনের শিকার তাঁদের দৈনন্দিন অত্যন্ত সাধারণ প্রতিটি কাজ, যেমন বিছানা থেকে ওঠা, খাওয়া, দাঁত মাজা, বেল বাজলে দরজা খোলা, সন্তানকে পড়ানো ইত্যাদি কাজই পঙ্গুর পাহাড় জয়ের মতো কঠিন।

সবচেয়ে জরুরি, ডিপ্রেশনের রুগীদের কথা শুনুন। রোজ। সময় ধরে, নিয়ম করে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতে পারে, ঘ্যানঘ্যানানি মনে হতে পারে। তা-ও শুনুন। এবং দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখুন। উপদেশ দেওয়ার বাসনা চেপে রাখুন। তাহলে রুগীর উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কাই বেশি থাকে।মনে রাখুন, প্রিয়জন অসুস্থ। চিকিৎসাই তাঁকে সুস্থ করতে পারে। আর সে জন্য শারীরিক যে কোনও রোগের মত এক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞরা আছেন।

আমাকে এখনও দৈনিক একগাদা সাইকিয়াট্রিক ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। হয়তো সারা জীবনই খেয়ে যেতে হবে। যেমন প্রেসার বা সুগারের জন্য খেয়ে যেতে হয়। থেরাপিস্টদের শেখানো পদ্ধতিতে মনটাকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করে যেতে হয়। আবার কখনও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। আবার বাঁচাবেন ডাক্তার, থেরাপিস্টরাই।

রোগাক্রান্ত কাউকে সুস্থ করতে তিনি সকাল থেকে রাত যে কাজগুলো করে যাচ্ছেন, যেগুলো তাঁর কাছে অত্যন্ত কষ্টকর মনে হচ্ছে, তার জন্য বাহবা দিন। অনেক ভুল করবেন রুগী। সেগুলোকে না-ই বা ধরালেন। আমাদের জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কতই না ভুল জড়িয়ে থাকে।

সব সময় দেখে বোঝা যায় না, ব্যক্তিমানুষের ভিতরের রক্তক্ষরণ, মানসিক ভাবে তাঁর একা হয়ে যাওয়া। হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, মেধাবী ছাত্র, সম্ভাবনাময় অভিনেতাটিরও তেমন হয়েছিল। আশপাশের কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ ইনস্টাগ্রামে মাকে মনে রেখে পোস্টটা হয়তো নিজের একাকীত্বের কথা সবাইকে বোঝাতে চেয়েছিল। হয়তো অবচেতনে। দোহাই, ছেলেটির ক’জন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সে সব নিয়ে কাটাছেঁড়া করে অবসাদের কারণ খুঁজতে গিয়ে ওঁকে অপমান করবেন না। একটু, অন্তত একটু সংবেদনশীল হোন। (সংগৃহীত)

(অনেক কথা হয়ত বলা হল না। কিন্তু তাতে লেখা আরও লম্বা হয়ে যাবে। তাই এখানেই থামছি।)

শব্দের খেলায় মাতিয়ে দিয়ে, আবেগের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে লাইক-শেয়ার-কমেন্ট কুড়োতে লিখছি না। নিজের অভিজ্ঞতার কথা মেঠো ভাষায় কেঠো করেই বললাম। তাতে যদি একটা সুশান্তকেও বাঁচানো যায়…

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img