ডাঃ রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী: জানেন কি , সারা পৃথিবীতে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন কেউ না কেউ আত্মহত্যা করে মারা যাচ্ছেন ? প্রতি বছর আট লক্ষেরও বেশি ?
সুইসাইড কোনো জাতি ধর্ম ভাষা বর্ণ বিভেদ করে না । খুব ছোট থেকে বৃদ্ধ সুইসাইড করতে পারেন।
ডিপ্রেশন সুইসাইডের মূল কারণ হলেও অন্য বিভিন্ন মানসিক অসুখ, নেশা (বিশেষত অ্যালকোহল), দুরারোগ্য অসুখ যেমন ক্যান্সার বা নিউরোলজিক্যাল অসুখ, একাকীত্ব সুইসাইডের প্রবণতা এবং সুইসাইড সফল হবার সম্ভাবনা দুই-ই বাড়ায়। তবে ডিপ্রেশনের সাথে সুইসাইডের কার্যকারণ গত সম্পর্ক সবচেয়ে প্রবল।
ডিপ্রেশন রোগটা অনেকটা ডায়বেটিসের মত। ডায়াবেটিস যেমন একটি ভেতর ভেতর বয়ে চলা ক্ষয়রোগ , ডিপ্রেশনও অনেকটা তাই। একটা অগ্ন্যাশয় ধরে, অন্যটা ধরে ব্রেন। ডায়বেটিস যেমন কিওর নয় , কেবল কন্ট্রোল করা যায়, মানুন না মানুন ডিপ্রেশনও ঠিক তাই। প্রকৃত ডিপ্রেশন অসুখ কন্ট্রোল করা যায় চিকিৎসায়, কিওর নয়।
ঠিক এইখানে একটা কথা বোঝা খুব প্রয়োজন। ডিপ্রেশন আর মনখারাপ কিন্তু এক নয়। সব মনখারাপ যেমন ডিপ্রেশন নয়, সব ডিপ্রেশনে যে মন খারাপ থাকবেই , এমনও কিন্তু নয়। বস্তুত, ডিপ্রেশনে মন খারাপের থেকেও বেশি পাওয়া যায় স্বাদহীনতা , জীবন যেন স্বাদহীন হয়ে যায়, ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতাটাই হারিয়ে যায়।
মজার কথা , ভারতীয় উপমহাদেশে ডিপ্রেশন অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়েও প্রকাশ করতে দেখা যায় । দুরারোগ্য ব্যথা যন্ত্রণা অনেক সময়ই ডিপ্রেশনের এক বহিঃপ্রকাশ। ডিপ্রেশন এক বহুরূপী অসুখ ।
একটা স্তর পর্যন্ত কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি ডিপ্রেশনে কাজ করে। কিন্তু যেখানে ডিপ্রেশন severe ডিপ্রেশনের সীমা পার করেছে, সেখানে কাউন্সেলিং সেভাবে কাজ নাও করতে পারে। কারণ সাইকোলজিস্টের কথা বোঝা ও মানার মত মানসিক পরিস্থিতিই আর থাকে না তখন।
কিভাবে বুঝবো যে, আমার মন খারাপ শুধুই মন খারাপ নয় , বরং তা ডিপ্রেশনের লক্ষণ? যদি মন খারাপের সাথে সাথে শরীর সব সময় দুর্বল লাগে, যদি খিদে, ঘুম খুব কমে/বেড়ে যায়, যদি আত্মবিশ্বাস ভীষণ কমে যায়, যদি কোনো কিছু উপভোগ করার ক্ষমতা কমে যায়, যদি নিজেকে সবসময় হতাশ, অপদার্থ বা অপ্রয়োজনীয় লাগে, যদি জীবনকে বোঝা মনে হয় , যদি অকারণে ভীষণ অপরাধবোধ হতে থাকে – তবে আপনি ডিপ্রেশনের শিকার।
মনে রাখতে হবে ডিপ্রেশন একটা প্রসেস, যা কোনও stress – যেমন কোনও দুঃখজনক ঘটনা থেকে শুরু হতে পারে। কিন্তু একবার আগুন লাগলে যেমন লাইটার ফেলে দিলেও আগুন নেভে না – ঠিক তেমনই stress -এর কারণ চলে গেলেও ডিপ্রেশন automatically ভালো আর হয় না।
ডিপ্রেশন সম্পর্কে এখনও কিন্তু আমরা সব জানতে পারিনি। যেটুকু জানা গেছে তা হলো :
১) ডিপ্রেশন একাধিক রকমের হয় – প্রত্যেক রকমের চিকিৎসা কিন্তু আলাদা
২) Severe, suicidal ডিপ্রেশনের চিকিৎসা প্রায় সবক্ষেত্রেই সারাজীবন চলে। ওষুধের সাইড ইফেক্ট অবশ্যই আছে , কিন্তু দক্ষ অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্টের সবই থাকে নখদর্পণে।
৩) ডাইবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড বা হার্টের অসুখে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে ডিপ্রেশন ভীষণ ভাবে বেশি পাওয়া যায়। অনেক সময়ই undiagnosed ডিপ্রেশন থাকার কারণে এইরোগ গুলি দুরারোগ্য হয়ে ওঠে। অথবা বলা ভালো, যে সমস্ত রোগীর এই রোগগুলি সারছে না, তাঁদের অনেকেরই হয়তো ডিপ্রেশন রয়েছে, যা কারও নজরে আসেনি।
ডিপ্রেশন এবং তার জন্য আত্মহত্যার আজ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল, নিশ্চিত এবং অতিদ্রুত যে অব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, আমাদের ভুল ধারণা , অজ্ঞানতা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের ফলে আমরা প্রায় সবাই তার থেকে বঞ্চিত।
হ্যাঁ, সেই চিকিৎসাটি হলো ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপি বা প্রচলিত ভাষায় শক থেরাপি। আমাদের অকারণ ভয় ও অজ্ঞানতার মাসুল দিতে এই অসাধারণ চিকিৎসা প্রণালীটি আজ অবলুপ্ত হবার পথে।
সবশেষে একটা কথা বলি। কাউকে যদি মনে হয় তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন, তবে তাকে প্রশ্ন করুন সে আত্মহত্যা করার নেই ভাবছে কিনা ? নির্দ্বিধায় । অনেকে ভাবেন এই প্রশ্ন করলে হয়তো তার মনে আত্মহত্যার আইডিয়া চলে আসবে। জেনে রাখুন, এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কাজেই জিজ্ঞেস করুন।
আর হ্যাঁ, আত্মহত্যা একটা অসুখ। আগে যদি কারও আত্মহত্যার attempt করার history থাকে , যদি পরিবারে আরও কেউ আত্মহত্যা করে থাকেন বা কেউ যদি বলেন, আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়, তবে তাঁকে সিরিয়াসলি নিন ।
জানবেন আত্মহত্যা প্রতিরোধের সেরা অস্ত্র – আত্মহত্যা সচেতনতা । সচেতন হোন, সজাগ থাকুন।
Dr Rudraprosad Chakraborty, Neuro-psychiatrist, Manobikshan, Baharampur