সঞ্জয় বসাক, জগন্নাথ ভক্ত
জয় জগন্নাথ –
শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের প্রণাম মন্ত্র :
নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।।
অনুবাদ : পরমাত্মা স্বরূপ যাঁরা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর প্রায় অনেকদিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। একদিন তিনি গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। তাঁর “রাঙ্গা চরণকে” টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসল এক শবর। নাম ছিলো তার জরা। বাণের আঘাতেই অবশেষে বৈকুণ্ঠলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন কৃষ্ণ।
অপঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ তো আর পুড়ছে না ! তখনই এলো দৈববাণী, ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন,”এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।”
অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর জরা। শেষ অবধি তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের। দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলা। অবশেষে এখানেই ভগবানকে স্বপ্ন দেখল সে,”কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি।”
তখন থেকে নীল মাধব রূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ। এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির শ্রীক্ষেত্রে। এখন আমরা তাকে চিনি জগন্নাথধাম রূপে।
কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই। রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীল মাধবের কথা। ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা। এঁদের প্রত্যেকেই ধার্মিক ব্রাহ্মণতনয়। বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাঁদের বাড়ি। ললিতা শবর রাজ বিশ্ববসুর কন্যা। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের, বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন, রোজ সকালেই শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন।
কোথায় যান বিশ্ববসু! স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীল মাধবের পুজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। নীল মাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে তখন আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে।
বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত দিলেন, তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোন ভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু। বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। হরিবোল,হরিবোল,হরিবোল…
বনের মধ্যে পুজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পুজোয় বসলেন অমনি দৈববাণী হল,”এতদিন আমি দীন -দুঃখীর পুজো নিয়েছি, এবার আমি মহা উপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পুজো নিতে চাই।” ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্ট দেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দি করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে। বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে।
ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায়? কোথায় আমার নীলমাধব?
আটক হলেন শবররাজ। তখন দৈববাণী এল, সমুদ্রের জলে যা ভেসে আসবে দারু (কাঠ) রূপে, তা থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই দারু। অবশেষে দারুর একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র ও
বিদ্যাপতি।
জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনো ভেদাভেদ নেই যে !! মহারাজ তাঁর কারিগরদের লাগালেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙ্গে। তা হলে উপায় !! মূর্তি গড়বে কে? মহারাজের আকুলতা দেখে ও জগন্নাথের আদেশে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। তিনিই গড়বেন মূর্তি। তবে শর্ত একটাই। একুশ দিন আগে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।
শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রানি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। কী হল ! কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে রানি মহারাজকে জানাতেই ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা।
ভেতরে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও। পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত বিগ্রহ। তাদের হাত, পা কিছুই গড়া হয়নি। গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙ্গে পড়লেন রাজা। তখন তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে জগন্নাথ বললেন যে, এমনটা আগে থেকেই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের বিগ্রহ ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে……
চলবে ……