বর্ণালী জানা
সেই কোন দূরের গ্রাম থেকে ছেলেটা এসেছিল কলকাতায়। সে আজ বছর পঁয়তাল্লিশ আগেকার কথা। পকেটে মকবুল ফিদা হুসেনের ঠিকানা। চায়ের দোকানে ফাই-ফরমাশ খাটা ছেলেটার আঁকার হাত দেখে এক শুভানুধ্যায়ীই ঠিকানাটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। হুসেনের কাছে গিয়ে পড়লে ছেলেটারএকটা যা হোক হিল্লে হয়ে যাবে । ফিদা হুসেনের নাম জীবনে শোনেনি ছেলেটা। অভাবের তাড়নায় লোকের বাড়ি গরু চরিয়ে, চায়ের দোকানে কাজ করে যাকে পেট চালাতে হয় তার কাছে ফিদা হুসেনের নাম পৌঁছবেই বা কী করে! তবে ছেলেটার তীব্র জেদ। মনে প্রাণে সে শিল্পী। হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই বানিয়ে ফেলে কত নতুন নতুন জিনিস! মনিবের বাড়ির উঠোন, চৌবাচ্চার দেওয়াল ভরে যায় ছবিতে। মাটি পেলেই বানিয়ে ফেলে কত রকমের পুতুল! পাড়ার সরস্বতী পূজার মূর্তিটা তারই বানানো চাই। অনেকে বলেছিল আর্ট কলেজে ভর্তি হতে। কিন্তু নুন আনতে যার পান্তা ফুরোয় তার কাছে তো এটা নিছকই বিলাসিতা।
তারপর কলকাতায় আসে ছেলেটা। এত বড় শহরের রকম সকম দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা পথ হারিয়ে ফেলে। সন্ধে হয়ে গেছে। এখন যেটা দেশপ্রিয় পার্ক সেখানেই ফুটপাথে হাল ছেড়ে দিয়ে সে বসে পড়ে। পকেটে পয়সা নেই। খাবার জোটে না। কিন্তু তার মধ্যেই ইটের টুকরো নিয়ে ফুটপাথে বসে আঁকিবুকি কেটে যায়। পরের দিন সকালে ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। ফুটপাথে এমন সুন্দর ছবি দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। দয়াপরবশ হয়ে ছেলেটাকে নিয়ে যান নিজের বাড়ি। রামকুমারের জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। গৃহকর্তা শিক্ষাবিদ, বড় কমরেড। বাড়িতে জ্যোতি বসু, শচীন সেনদের আনাগোনা। একটা বড় দিগন্ত খুলে গেল রামকুমারের সামনে। নানা রকম হাতের কাজ দিয়ে বাড়ি সাজান। ভদ্রলোকের স্ত্রী কাজ করেন নামী স্কুলে। সেখানে ক্রাফটের ক্লাশ হয়। রামকুমার সেখানেও অনেক কাজ করে দেন। সেখানেই একদিন খবরের কাগজে পড়লেন ফিদা হুসেনের কথা। বুঝতে পারলেন কত বড় সুযোগ তিনি হারিয়েছেন!
সে বাড়িতে আসতেন স্বনামধন্য কবি, পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। রতন চিনে নিতে ভুল হয়নি জহুরির। রামকুমারকে তিনি নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি। রামকুমার ফিল্মের সেটে কাজ করে। নামী পরিচালকের বাড়িতে ততদিনে অনেক পরিচিতি বেড়েছে রামকুমারের। নিজের হাতের কাজ নিয়মিত বিড়লা অ্যাকাডেমি , অ্যাকাডেমি অফ ফাইনআর্টসের প্রদর্শনীতে জমা দেন।
কিছুদিন পর আবার সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ভেসে যান অন্যত্র। হরিদেবপুরে ভাইদের সঙ্গে বাসাভাড়া নিয়ে পোড়ামাটির কাজ করার ভাবেন। সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে বা আশির দশকের প্রথম দিকে টেরাকোটা নিয়ে কাজ বিশেষ হতনা। টেরাকোটা বলতে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল কি বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের ঘোড়া। আর ছিল কালীঘাটের এক ধরণের মাটির মূর্তি…কাঁচা মাটির ওপর কালো রং লেপে তৈরি। রামকুমার পোড়ার মাটির নানা জিনিস…ফুলদানি…ওয়াল হ্যাঙ্গিং… অ্যাশট্রে তৈরি করে দোকানে দোকানে নিয়ে যেতেন। দেখতে দেখতে কাজের কদর বাড়ে। দোকানিরা এবার নিজে থেকেই তাঁর কাছে কাজ চেয়ে পাঠায়।
গণেশের মূর্তি বানানোর একটা বরাবরের শখ ছিল। নানান রকমের, নানান ফর্মের গণেশ। এক বন্ধুর সাহায্যে চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে গণেশ নিয়ে একটা শো করলেন। প্রথম দিনেই প্রায় সব গণেশ বিক্রি হয়ে গেল। গ্যালারির কর্ণধার প্রকাশ কেজরওয়াল খুশি হলেন। রামকুমারের হাতে টাকা এল। এবার টেরাকোটাই হল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। টেরাকোটা এত বড় বড় মূর্তি আর আগে কেউ তৈরি করেনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চিত্রকূট গ্যালারি, কাতায়ুন গ্যালারি একের পর এক শো হয়। তাঁর শিল্পকর্ম যায় জাহাঙ্গির গ্যালারিতে। দিল্লি, আমেদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, লন্ডন—কোথায় না শো করেছেন তিনি। বিড়লা, গোয়েংকা, পোদ্দার, বাজোরিয়া…সবার বাড়িতেই রয়েছে তাঁর পোড়ামাটির কাজ। তাঁর কাজ রয়েছেন গণেশ পাইনের বাড়িতে। চিত্রকূট গ্যালারিতে তাঁর শো দেখতে এসেছেন স্বয়ং ফিদা হুসেন। জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে এভাবেই।
তাঁর টেরাকোটার কাজের ধরণটাই একেবারে আলাদা। মাটির গন্ধ শুঁকেই বুঝে যান সে মাটির জিনিস টিকবে কতদিন। টালিগঞ্জ মেট্রো থেকে তিন কিলোমিটার দূরে শান্তিনগর মিশন মোড়ে তাঁর বাড়িটিই টেরাকোটার আস্ত একটা মিউজিয়াম। প্রায় হাজার খানেক ভাস্কর্য রয়েছে… একদিনে যা দেখে শেষ করা যাবে না। বাড়ির দেওয়ালে টেকারোটার কাজ। ড্রয়িং রুমের সোফা, ঘড়ি…সবই টেরাকোটার। তাঁর কাজের বিষয়বস্তু মূলত পুরাণ। কিন্তু সেই পুরাণের কাহিনিকেও নিজের মতো করে নিয়ে মূর্তি গড়েছেন তিনি। বাড়ির পাশেই স্টুডিও…তাঁর শিল্পকর্মের আঁতুড়ঘর। নিজের উদ্যোগে বানানো এই মিউজিয়ামকে তিনি এতদিন প্রচারের আলোর বাইরেই রেখেছেন। মিডিয়ার শিরোনামে তিনি থাকতে চান না রামকুমার মান্না। চান শুধু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের সাধনা চালিয়ে যেতে।