হোমফিচারএকলা বৈশাখের ভাবনা

একলা বৈশাখের ভাবনা

একলা বৈশাখের ভাবনা

বর্ণালী জানা বর্ণালী জানা

পৃথিবী থেকে দূর হোক বিদ্বেষের ভাইরাস।

রমনার মাঠে আজ আর শোনা যাবে না ‘এসো হে বৈশাখ’। ইলিশ পান্তাভাতের আয়োজনও বাতিল। পাড়ায় পাড়ায় প্রভাতফেরি নেই। কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরে নেই পুণ্যার্থীদের লম্বা লাইনও । হালখাতার উৎসবও নমো নমো করে। পৃথিবীর গভীর…গভীরতর অসুখ আজ। সারা পৃথিবী আজ লড়ছে এক শত্রুর বিরুদ্ধে…যার নাম করোনা। এই মারণ ভাইরাসের কাছে প্রথম বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশগুলিও নেহাতই অসহায়। কাতারে কাতারে মানুষ মরছে। তাই পৃথিবীজুড়ে আজ লকডাউন। মানুষ গৃহবন্দি। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর নিয়ম মেনে বন্ধ হয়েছে সব উৎসব অনুষ্ঠান। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে আজ নেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান, পাঞ্জাবে নেই বৈশাখী, অসমে নেই বিহু, তামিলনাড়ুতে নেই পুথান্ডূ। অসম সরকার জানিয়ে দিয়েছে কোনওমতে বিহুর পতাকা উত্তোলন করেই নিয়ম রক্ষার কথা।

তবে প্রাপ্তির ঝুলিতে কি একেবারেই কিছুই নেই? এই যে গোটা দুনিয়ার মানুষ যে আজ একসঙ্গে লড়ছে, এই বিপর্যয় না এলে তা কি সম্ভব হত! দুর্দিনেই তো একজোট হয় মানুষ। তখন আর প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিশ্বের ভেদাভেদটা থাকে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বরিস জনসনের উন্নাসিকতাও ধুয়ে-মুছে যায়। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের জন্য ভারতের কাছে কাতর অনুরোধ জানায় আমেরিকা। এই এক মারণ ভাইরাস এসে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে মানুষের যা কিছু দম্ভ…পরাক্রম। বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির প্রতিশোধ কতটা ভয়ানক হতে পারে!

তাই কিছুটা হলেও মানুষের বোধোদয় হয়েছে। কালোবাজারি…চুরি, ছিনতাই-এর অন্ধকার পথ তো রয়েইছে…কিন্তু তার পাশেই রয়েছে একটা আলোকোজ্জ্বল পথ…যেখানে আছে মানুষের শুভবুদ্ধি আর অদম্য উৎসাহ। আজ মানুষ, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। যে যার সামর্থ্য মতো মানুষকে সাহায্য করছে। পেনশনের টাকায় সংসার চালানো মানুষটা যখন তার পেনশনের সব টাকা মানুষের ত্রাণে দিয়ে দেন…বা ক্যান্সার আক্রান্ত যে মানুষটা পাড়ার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাজার করে দেন…ওষুধপত্র এনে দেন, তখন কি আর বলা যায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়েছে!

হাসপাতালে বেড নেই, উপযুক্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই তারপরও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যে চিকিৎসক, যে নার্স মানুষের সেবা করে যান, মাতৃত্বকালীন ছুটি না নিয়েও একরত্তি শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে যে অফিসার মানুষের জন্য কাজ করে যান, কর্তব্যের তাগিদে যে নার্স নিজের শিশুসন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখেন তাদের দেখে কি মনে হয় মানুষের শুভবুদ্ধি আজ পরাহুত!

উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা নয়, আজ মানবিকতাবোধের উদযাপনের সময় এসেছে। করোনাকে তো আজ আজ-না হয় কাল পরাজিত করাই যাবে কিন্তু পৃথিবীতে যে হানাহানি, বিদ্বেষ, ভেদাভেদের ভাইরাসটা রয়ে যাবে তার কী হবে! কোন ভ্যাক্সিন দিয়ে তা প্রতিরোধ করা যাবে? তারও উত্তর মনুষ্যত্ব। আজ এই বিপদের দিনে মানুষ যেমন একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিপদ কেটে যাওয়ার পরও যেন তাদের এই ঐক্য বজায় থাকে, সম্প্রীতি বজায় তাহকে…তথাকথিত শক্তিধর দেশগুলির ক্ষমতার আস্ফালন বন্ধ হোক, দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ থামুক, ভ্রাতৃহত্যা বন্ধ হোক, ছায়াযুদ্ধ বন্ধ হোক, ধর্মে-ধর্মে হানাহানি বন্ধ হোক, সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক—তাহলেই সম্পূর্ণ হবে মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। বৈশাখের এই পুণ্যপ্রভাতে অগ্নিস্নানে এই বসুন্ধরা শুচিশুদ্ধ হোক।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img