সংযুক্তা সরকার
‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। এতোদিন মূলত সফ্টওয়্যার পেশার সঙ্গে যুক্ত এই ‘কনসেপ্ট’ বা কাজের পদ্ধতি করোনার দৌলতে এখন ঘরে ঘরে। ‘বাড়ি থেকে কাজ’ অর্থাৎ অফিসে না গিয়ে নিজের ঘরে বসেই ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের সাহায্যে অনলাইন থেকে কাজ করা। এই সুবিধা এদেশে এতদিন পর্যন্ত শুধু তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্র সহ কিছু কিছু ‘হোয়াইট কলার’ কর্মীরাই ভোগ করে আসছিলেন। অন্য কাজে খুব বেশি পরিচিতি ছিল না এই পদ্ধতির। কিন্তু গোটা বিশ্বে মহামারীর আকার নেওয়া করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় সতর্কতা হিসেবে আজ বেশিরভাগ সংস্থাই কর্মীদের জন্য চালু করেছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর সুবিধা। হোয়াটস্যাপ এবং স্কাইপের সাহায্যেও চলছে কাজ। ঘরে বসেই।
কর্মীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিলায়েন্স-সহ দেশের প্রথমসারির সংস্থাগুলি৷ হাসপাতাল, রিটেল স্টোর, টেলিকম অফিসগুলি খোলা থাকলেও সেখানে অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক কর্মীদের নিয়েই কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাগুলি৷ যার ফলে বাড়ি থেকেই আরও বেশি পরিমাণে ডিজিটাল পরিষেবা ব্যবহারের মাধ্যমে ভাল কাজ করা সম্ভব হবে৷ ব্যবসাও চালু থাকবে। যোগাযোগ রাখতে সংস্থার অভ্যন্তরীণ মাধ্যমগুলির পাশাপাশি আউটলুক, এমএস টিম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেরও সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু করেছে শহরের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। করোনার সতর্কতায় আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সমস্ত সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পরামর্শে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালন কমিটিও স্কুল, কলেজ ক্যাম্পাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সিলেবাস, সেমেস্টারের চাপ রয়েছে। হঠাৎ এতো লম্বা ছুটি পড়াশোনায় ক্ষতি করবে নিঃসন্দেহে। এতগুলো কাজের দিন নষ্ট হলে শিক্ষক, অধ্যাপকদের পাশাপাশি ভুক্তভোগি হতে হবে পড়ুয়াদেরও। তাই অভিভাবক-ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে অনেক প্রতিষ্ঠানই অনলাইন ক্লাস চালু করেছে এবং চালু করার চেষ্টায় রয়েছে। ইতিমধ্যেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সঙ্গে অনলাইনেই পড়াশোনা ঝালিয়ে নিতে চোখে পড়ার মতো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে পড়ুয়াদের মধ্যেও। রীতিমতো কনফারেন্সের মাধ্যকে ক্লাস চলছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। জোরকদমে পড়াশোনা চালাচ্ছে ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও। কেমব্রিজ বোর্ডের এই স্কুলের এখনও বার্ষিক পরীক্ষা বাকি। তার জন্য ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুতি চলছিল। সেই সময় করোনা আতঙ্কে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত। কিন্তু কালবিলম্ব করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকদের ইমেইল ও বিদ্যালয়ের নিজস্ব সোশ্যাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে চলছে পঠনপাঠন, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান। ঘরে বসেই ওয়ার্কশিট বানাচ্ছেন শিক্ষক শিক্ষিকারা। অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করছে পড়ুয়ারাও। এছাড়াও বেশ কিছু সরকারি বেসরকারি কলেজেও নিজেরাই অনলাইনে পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নিচ্ছেন শিক্ষকরা।
চিকিৎসা পরিষেবা, পুলিশি ব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যমের মতো বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা ছাড়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই ন্যূনতম কর্মী দিয়ে কাজ সামলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বাকিদের বাড়ি থেকেই কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। থিয়েটার বন্ধ। বন্ধ হতে চলেছে শপিং মলগুলিও। বন্ধ হয়ে গিয়েছে সিনেমা, সিরিয়াল ও রিয়ালিটি শো-এর শুটিং। ঘরে বসে গান-বাজনার চর্চা, পরিবারের মানুষ, ভালো বই পড়ার অথবা ছবি দেখার অনুষঙ্গে হঠাৎ পাওয়া ছুটি কাটাচ্ছেন অভিনেতা অভিনেত্রী ও কলাকুশলীরাও। ব্যস্ত থাকছেন নানারকম গঠনমূলক কাজে। তাঁদেরও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বই কী!
কিন্তু বাড়ি থেকে কাজ হচ্ছে না সেইসব শ্রমিক ও দিন মজুরদের, দূরদূরান্ত থেকে ট্রেনে, বাসে চড়ে শহরের নানা প্রান্তে যাঁরা কাজ করতে আসেন দিন দিন, প্রতিদিন। টাওয়ারের পর টাওয়ার বানিয়ে আকাশচুম্বী বাড়ি তুলছেন যাঁরা, তাঁদের কাজ কীভাবেই বা হবে “বাড়ি” থেকে? গড়িয়াহাটের যে হকার রোজ এসে দাঁড়ান পসরা সাজিয়ে, চৈত্র সেলের বাজারে কিছু রোজগারের আশায় যাঁর বুক বাঁধা, তিনিই বা কী করেন এই অকালে? ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলবে না সবজি বিক্রেতা শ্যামল বা ফলওয়ালা আরিফের। মুড়িয়ালী যে মাসি প্রতিদিন চাকদহ থেকে শিয়ালদাহ আসেন তাঁর মুড়ি সে কোথায় বেঁচবে? প্রশ্ন তো সেটাও? উত্তর কী জানা???