দেবদাস কুণ্ডু
আমার খুব, খুব ভয় করছিল।
কেন এতো ভয় পেয়েছিলে সুচেতনা?
কি বলছো বিশাল, ভয় পাবো না? ওভাবে কেউ চলন্ত ট্রেনের জানলা ধরে ঝুলে পড়ে?
হাত ফসকে পড়ে যেতাম। হয়ত মরে যেতাম। তবু সেটা ভালো ছিল।
মরে যাওয়াটা ভালো? কি যে বলো না তুমি।
পাঁচটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরেছে স্টেশনের আবছা অন্ধকারে। একজনের হাতে ছুরি। সে বলল—তোকে এর আগে একদিন বলেছি ওটা আমার মাল। তারপরও তুই ওর সঙ্গে প্রেম করছিস? তোর সাহস তো কম নয়। আজ তোর কি দশা করি দেখ। কোন বাবা তোকে বাঁচাতে আসবে না।
তখন আমার কি যে হয়ে গেল। আমি যাকে ভালোবাসি তাকে ও মাল বলছে। জোর করে দখল নিতে চাইছে? এ কি জমি নাকি? একটা মেয়ের সম্মান নেই? এই অসম্মানের পর আমি কোনও প্রতিবাদ করবো না? ভয়ে পালিয়ে যাবো? মনে হলো, আমার তো প্রেম করার কোন যোগ্যতা নেই। ছুরিটা তুলে ধরেছিল ছেলেটা। প্লাটফর্মের শেষ প্রান্ত।
এদিকে আরপিএফ নেই। যাত্রীও নেই। সামনের দিকের কামরা ফাঁকা থাকে। তাই ওকে নিয়ে সামনের দিকে আসি। ও বসে যেতে পারে। যাবে বাটানগর। কম দূর তো নয়। সারাদিন কারখানায় কাজ করে সুচেতনার শরীর ক্লান্ত থাকে। সুচেতনা ভিতরে বসে আছে। ও বোধ হয় কিছু টের পায়নি। পেলেও ও কি করবে? অন্ধকারে ছুরি চক চক করছিল। একবার পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারলে ওদের কেল্লা ফতে।
আমি যে ভয় পাইনি তা নয়। ওরা চারজন। হাতে অস্ত্র। আমি একা। নিরস্ত্র। মৃত্যু নিশ্চিত। তবু শেষ কামড়টা দিই। যা হবে দেখা যাবে। ওরা বুঝুক নিরস্ত্র মানুষের সাহসই অস্ত্র। আমি হঠাৎই আমার ডান পা তুলে সজোরে একটা লাথি মারি ছেলেটির পেটে। ছুরি ছিটকে পড়ে। ছেলেটা ভারসাম্য না রাখতে পেরে পড়ে যায়। তখন ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমি দৌড়ে গেলাম। ট্রেন তখন স্পিড নিয়েছে। আমি জানি এখন প্লাটফর্মে থাকলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
আমাকে ট্রেনে উঠতেই হবে। অগত্যা ছুটতে ছুটতে কামড়ার রড ধরতে না পেরে জানালা ধরে ঝুলে পড়ি।
ট্রেনের মধ্যে লোকগুলি যখন হৈচৈ শুরু করেছে তখন দেখি তুমি। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কারণ ঐ ট্রেন পার্ক সার্কাস ধরবে না। সোজা বালিগঞ্জ ধরবে। এতটা পথ ঝুলে ঝুলে যেতে পারবে? আমি দেখছি তুমি বার বার হাত বদল করছো। বড় ভয় হচ্ছে। একজন হাত বাড়িয়ে দিলে তুমি ভিতরে আসতে পারলে। না হলে কি যে হতো?
কি হতো? মরে যেতাম। একদিন তো মরতে হবে। তবু সান্ত্বনা থাকবে প্রেমের জন্য মরেছি।
আমার রাগও হচ্ছিল কত দিন তোমায় বলেছি, আমাকে রোজ পৌঁছে দিতে শিয়ালদহ আসতে হবে ন। ওরা বাজে ছেলে। অনেকদিন ধরে আমার পিছনে লেগেছে। ব্রেস ব্রিজ থেকে ওঠে। আমাকে ডিসটার্ব করে। আর কি করবে ওরা? তবু তুমি শোনোনি।
শোনো সুচেতনা, আমি ভীতু ছেলে।
ওরা খুব সাহসী।
ভীতু মানুষ কখনও কখনও সাহসী মানুষকে ছাড়িয়ে যায়। তার মধ্যে তখন এক আশ্চর্য শক্তি ভর করে।
আমি বাবা অত কিছু জানি না। বেশি লেখাপড়া শিখিনি। তা না হলে বাটানগর থেকে একটি মেয়ে উল্টোডাঙায় কাজে আসে?
সুচেতনা কিছু সময় চুপ থাকলো। তারপর বলল, ওরা অতো গুলো ছেলে তুমি ওদের সঙ্গে কতদিন লড়বে?
যতদিন তুমি পাশে থাকবে।
শেষ পর্যন্ত আমিই পাশে থাকতে পারিনি। রেলের চাকরি পেয়ে চলে যেতে হয়েছিল ধানবাদ। প্রথম দিকে কিছু দিন চিঠির মাধমে যোগাযোগ ছিল। তারপর আবার নতুন পোস্টিং হল রাজগীর। তারপর….
কি গো কি এতো মনোযোগ দিয়ে কাগজ পড়ছো? বিশেষ কোন খবর আছে নাকি? স্ত্রী রিনা বললো।
পড়া হয়ে গেছে, ভাবছিলাম…
কি ভাবছিলে?
প্রেমিকাকে বাঁচাতে প্রেমিক ছুরিকাহত। কাগজে খবরটা পড়ে ভাবছিলাম।
এতে আবার ভাবার কি আছে? প্রেমের জন্য মানুষ কি না করে? বাংলা গল্পে উপন্যাসে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। এতো নতুন কিছু নয়। আমাদের সময় ছিল। এখনও আছে। পরেও থাকবে। এই নিয়ে কেউ ভাবে নাকি?
তুমি আমার মোবাইলটা দাও তো।
কেন?
কাগজের অফিসে একটা ফোন করতে হবে।
কেন? রিনা জিজ্ঞেস করল।
ছেলেটি কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে সেটা জানবো। তারপর হাসপাতালে ফোন করে জানবো, কোন ওয়ার্ডে কত নম্বর বেডে ভর্তি আছে।
এতো হাঙ্গামা করে ছেলেটির খোঁজ নিছো কেন? কে হয় ছেলেটি তোমার?
রিনা, ঐ ছেলেটি আমি।