নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সর্দি, কাশি, বা পেট খারাপের মতো ব্যামোর সঙ্গে বাঙালি যতটা পরিচিত, “স্লিপ অ্যাপনিয়া” নিয়ে ঠিক ততটা ধারণা নেই বললেই চলে। ডাক্তার, বদ্যিরাও এ সম্পর্কে কতটা সচেতন, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। স্লিপ অ্যাপনিয়া আসলে কী? “অ্যাপনিয়া” বলতে আমরা বুঝি শ্বাস বা দম বন্ধ হওয়া। আর “স্লিপ অ্যাপনিয়া” মানে, ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঘুমের মাঝে ১০ সেকেন্ড বা তার বেশি সময় ধরে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, সঙ্গে প্রবল নাক ডাকা, এমনকী মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে ঘেমে নেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া। যার ফলশ্রুতি দিনভর ঝিমুনি, কাজে মনসংযোগের অভাব। দিনের পর দিন এই লক্ষ্ণণ প্রকট হতে থাকলে গড়িমসি করা মোটেই উচিত নয়। এ ব্যাপারে সচেতন না হলে অপনার অজান্তেই শরীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা অসুখটি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। হঠাত করে যে এই রোগটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা কিন্তু নয়। ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞরা রোগটি সম্পর্কে কী বলছেন? এই অসুখের উপসর্গ কী? নিরাময় কোন পথে?
কুম্ভকর্ণের মতো নাক ডাকিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন, এর মধ্যে নিশ্চিন্তের কিছু নেই, উল্টে ডেকে আনতে পারে মহা বিপদ। আপনার নাক ডাকা কি অন্যের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে? বা এমন জোরে নাসিকা গর্জন করছেন যে পাশের ঘরে পর্যন্ত সেই শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে? আপনার পরিবারের যদি কেউ এমন থাকেন, যিনি রাতের পর রাত ঘুমের মধ্যে প্রবল নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন, অথচ দিনের বেলায় “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু”র মতো অবস্থা, হতে পারে তিনি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। দেরি না করে ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন।
ইতিহাসের পাতা থেকে : চিকিতসা বিজ্ঞান থেকে বেরিয়ে একটু ইতিহাসের দিকে নজর ঘোরানো যাক। সরাসরি না হলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া সংক্রান্ত বিষয়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জার্মানির Ondine”s Curse এ। সেই গল্পে এক জলপরী তাঁর অবিশ্বস্ত স্বামীকে অভিশাপ দেয়, যখনই সে নিদ্রা যাবে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়টিকে কোনও ব্যক্তির একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে নেওয়া হলেও, চিকিতসাবিজ্ঞানে তার কোনও সদুত্তর মেলেনি। অনেক পরে বিশ শতকের বিখ্যাত চিকিতসক William Osler পিকউইকিয়ান সিনড্রোমের কথা বলেন, যেখানে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষ্ণণ বা উপসর্গের কথা বলা হয়। চার্লস ডিকেন্সের The Pickwick Papers সাহিত্যে “জো” চরিত্রের মধ্যেও স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষ্ণণ খুঁজে পাওয়া যায়।
স্লিপ অ্যাপনিয়া ও তার রকমফের
এটি এমন একটি ঘুমের অসুখ যাতে ব্যক্তির ঘুমের সময় শ্বাস নেওয়া ক্রমাগত বন্ধ হয়ে যায় ও আবার শুরু হয়। একজন স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত রোগীর ঘুমের মধ্যে ঘণ্টায় ত্রিশ বা তার বেশি বার শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যেতে পারে এবং এই বন্ধ অবস্থা ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এরপর আবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস চালু হয়। অনিয়মিত শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে শুরু হয় নাসিকা গর্জন । ঘুমের বারোটা বেজে যায় পাশের ব্যক্তির।
স্লিপ অ্যাপনিয়াকে বিশেষজ্ঞরা মূলত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন প্রথমটি হল, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া যেখানে নাক থেকে শ্বাসনালীর কোথাও কোন একটি বাধা প্রশ্বাসের কাজকে বাধা দেয়। রোগী যখন জোর করে শ্বাস নেওযার চেষ্টা করেন, তখনই নাক ডাকার শব্দ হয়। যে কারোরই এই সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন ও ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বড় টনসিল এই ধরণের রোগীর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় ধরণটি হল,সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া, যেখানে মস্তিষ্ক থেকে শ্বাস নেওয়ার সংকেত শ্বাস প্রশ্বাসের পেশিতে পাঠানো হয় না।
কীভাবে বুঝবেন স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়েছে:
১. ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হওয়া বা খাবি খাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া
২. অচমকা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া
৩. প্রবল নাসিকা গর্জন
৪. সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও দিনভর গা ম্যাজম্যাজে ভাব, ক্লান্তি, মুখে বিষণ্ণতার ছাপ
৫. ঝিমুনি ও কাজে মনসংযোগে ব্যাঘাত
৬. ওজন বাড়া
৭. উচ্চরক্ত চাপ
শুনুন অভিভাবকগণ: শুধু পুরুষ বা মহিলারাই নন, মন দিয়ে শুনে রাখুন স্লিপ অ্যাপনিয়া থাবা বসাতে পারে আপনার সন্তারের শরীরেরও। সজাগ থাকতে হবে আপনাকেই। লক্ষ্য রাখুন দিনের পর দিন বাচ্চা ঘুম থেকে উঠে যদি খিটখিট করে বা ক্লাসে পড়াশুনোয় অমনযোগী হয়, দেরী না করে বিশেষজ্ঞের কাছে যান, সন্তানের বয়স বাড়লেও তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে স্লিপ অ্যাপনিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন রোগের কোনও বয়স নেই, হালফিলে দেখা যাচ্ছে বড়দের রোগও ছোটদের শরীরে বাসা বাঁধছে। অপনার সন্তান বা সন্ততি যদি রাতে নিয়মিত বিছানা ভেজায় বা নাক ডাকে বা ঘুমের সময ছটপট করে, পাশাপাশি স্কুলে অমনযোগী হয়, তাহলে সতর্ক হতে হবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা করা জরুরি।
স্লিপ অ্যাপনয়া নির্নয় পদ্ধতি: পলিসমনোগ্রাফির মাধ্যমে দেখা যায় ঘুমের মধ্যে রোগীর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কত কমেছে, কতবার নাক ডাকছে, কতবার দম বন্ধ হচ্ছে। স্লিপ এন্ডোস্কোপি র মাধ্যমে রোগীকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান করে এন্ডোস্কোপ ঢুকিয়ে শ্বাসনালীর কোথাও বাধা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখা হয়।
রোগ নিরাময়ের দাওয়াই : ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খাওয়া, পরিমিত আহার ও ব্যায়াম, মদ ও সিগারেট থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, ঘুমের ওষুধ না খাওয়া, বিশেষ মাস্ক ( সি-প্যাপ) পরে শোওয়া, এতে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক থাকে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া নিরাময়ে সবে থেকে প্রচলিত ও স্বীকৃত চিকিতসা পদ্ধতি হল কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ার প্রেসার বা সিপিএপি। এই চিকিতসা পদ্ধতি নিরাপদ এবং কার্যকরী। বিছানার পাশে রাখা একটি যন্ত্র মুখোশের মাধ্যমে হালকা ভাবে হাওয়া ঠেলতে থাকে, ফলে শ্বাস পথ বাধাপ্রাপ্ত হয় না খোলা থাকে, শ্বাসরোধ হওযার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না। হৃদরোগ বা স্ট্রোকের মতো সঙ্কটজনক পরিস্থিতি এড়ানো যায়। সিপিএপি আবিস্কারের হাত ধরেই ঘুম সংক্রান্ত এই অসুখটির নিরাময়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। ১৯৮১ সালে চিকিতসক COLIN SULLIVAN এবং তাঁর সহযোগীরা সিডনিতে প্রথম সিপিএপির প্রয়োগ করে সাফল্য পান। তবে গোড়ার দিকে যন্ত্রটি ছিল বেশ বড়সড় এবং ব্যবহারের সময় শব্দ হত। কিন্তু পরের দিকে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অসুখ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮ এপ্রিলকে স্লিপ অ্যাপনিয়া ডে হিসেবে চিহ্নিত করেন Colin Sullivan।
স্লিপ অ্যাপনিযার চিকিতসা খুব ধৈর্য সাপেক্ষ। জীবনশৈলীর পরিবর্তন বিশেষ করে খাদ্যাভাসের বদলএনে ব্রিদিং ডিভাইস ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করে এই অসুখের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। তবে নাক ডাকার মতো ঘটনাকে ছোটো বিষয় ভেবে ফেলে রাখলে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মতো রোগ শরীরে চেপে বসতে পারে। শ্বাসরোধ হয়ে নানা গুরুতর সমস্যা এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। এ প্রসঙ্গে ডাক্তাররা আরও একটি ভুল ধারনার অবসান ঘটিয়েছেন। শুধুমাত্র মোটা লোকেরাই স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত হবেন, এমনটা নয়। রোগা পাতলা পুরুষ ও মহিলারাও এই রোগের খপ্পরে পড়তে পারেন।
স্লিপ অ্যাপনিয়া সনাক্তকরণ খুব একটা সহজ কাজ নয়। রোগী বেশিরভাগ সময়ে এ সম্পর্কে সচেতন থাকে না। পরিবারের অন্য কারো কাছে শুনে বা তাদের সাহায্য নিয়ে রোগ সনাক্ত করতে হয় ডাক্তারদের। তাই পরিবারের কারো এ ধরণের সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা করবেন না। কারণ আপনার একটু সচেতনতা একজন রোগীর নির্বিঘ্ন ঘুম এনে দিতে পারে। উপহার দিতে পারে তরতাজা দিনের। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মত, জীবনাত্রার গঠনমূলক পরিবর্তনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রোগ নিরাময়ের আসল চাবিকাঠি।