সংযুক্তা সরকার
রবীন্দ্রভারতী কাণ্ডে রাতারাতি বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত হয়ে শিরোনামে উঠে আসা রোদ্দুর রায়ের ওপর যাবতীয় “ফেসবুকীয়” রাগ বর্ষণের আগে পারলে একটু থামুন। একটু ভাবুন। যদিও এই থামাটা এবং ভাবাটা এখনকার রেওয়াজ নয়। একেবারেই নয়। বরং ইঁদুর দৌড়ে ছুটে বেড়ানোটাই নিয়ম। বাকিটা পুরোটাই “ওল্ড স্কুল”।পিছিয়ে পড়া। কিন্তু তা সত্বেও তড়িঘড়ি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘প্রতিক্রিয়া’-শীল না হয়ে যদি একটু সাময়িক বিরতি নিতে পারেন, যদি একটু ভাবেন তাহলে কিন্তু অন্য অনেকগুলো দিক চোখে পড়বে। বাংলার অবমাননায়, রবীন্দ্রনাথের গানের কদর্য বিকৃতিতে, অশালীন শব্দের ভিড়ে যেগুলো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে। অথবা আপনি এতটাই রেগে গেছেন যে চোখে পড়ছে না।
ইউটিউবে অদ্ভুত গা জ্বালা ধরা ছবি ও শব্দ সহযোগে (যা বেশিক্ষণ সহ্য করাও কঠিন) রোদ্দুর রায়ের প্রতিটি আপলোড। অথচ এইসব ভিডিও এবং ফেসবুক পোস্ট, যেগুলো আমি-আপনি দেখেই হাঁসফাঁস করছি, উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে সেগুলির ভিউয়ারশিপ। একই ‘চাঁদ উঠেছিল বনে’র ডজনখানেক বা তারও বেশি ভিডিও এবং তাতে ভিউয়ার্স কমেন্ট বা মন্তব্যগুলিতে চোখ বোলালে বোঝা যাচ্ছে একটা রোদ্দুরের গল্প এটা নয়। এক রোদ্দুরের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার রোদ্দুর। যারা রোদ্দুরের ভিডিও পছন্দ করছেন, খুশি হচ্ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন এবং নিয়মিত নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। লক্ষ্য করে দেখুন সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং ফেসবুকে আপনার ভার্চুয়াল গলাটি ফাটানোর আগে বুঝে নিন প্রতিপক্ষটি কে বা বলা ভালো “কারা”।
আজ চারটে মেয়ের পিঠে রবিগানের বিকৃত প্যারডির লাইন দেখে সবার চোখ কপালে (ওটা মেয়েদের পিঠ না হলে এতখানি রাগ হতো কিনা সেটাও অবশ্য ভাবনার। কারণ মেয়েদের মতোই ছেলেগুলোর বুকের লেখা নিয়ে কিন্তু খুব বেশি পোস্ট/ভাইরাল ছবি চোখে পড়লো না এখনও) । রাগ, অপমান। এতকিছু। অথচ এই ভিডিওগুলোর প্রায় প্রতিটি আপলোড করা হয়েছে অন্তত বছর তিনেক আগে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি এতদিন আমরা সহ্য করছিলাম? আর অশালীন শব্দগুলো শেষমেশ মেয়েদের পিঠ এবং রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্তউৎসবের উঠোনে উঠে আসাতেই আমাদের জার্ক লাগলো আর টনকটি নড়লো?
প্যারোডি অর্থাৎ ‘an imitation of the style of a particular writer, artist, or genre with deliberate exaggeration for comic effect ( অর্থাৎ, কোনো লেখক বা শিল্পীর কাজের ইচ্ছাকৃত এবং অতিরঞ্জিত নকল) এর আগেও হয়েছে বাংলা গানে। কলেজ ক্যাম্পাস এবং হোস্টেলের ঘরে ঘরে এসব গান গাওয়া হয়েছে নেহাতই মজার ছলে। যদিও সেগুলি আজকের মতো ভাইরাল হওয়ার সুযোগ পায়নি আগে।সমস্যা হলো এই রোদ্দুর রায় সেটুকু করেই ক্ষান্ত হননি, গানের লাইনে লাইনে গুঁজে দিয়েছেন গালাগাল ও অশালীন শব্দ। তাঁর দাবি, শিল্প ক্ষেত্র, রাজনৈতিক ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র সহ যাবতীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাই নাকি তাঁর লক্ষ্য। তিনি যেটা করেছেন সেটা ‘ডোপ কমেডি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর মতে, কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর তিনি এই ধরনের ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করতেই পারেন। এতে কারোর কিছু বলার জায়গা থাকে না।
এখন প্রশ্ন একটাই, পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়া বল লুকিয়ে রাখা, ছেলেপুলেদের নামে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নালিশ করে আসা, কথায় কথায় ‘আমাদের সময়ে এমনটা তো হয়নি’ বলে ভুরু কুঁচকানো পাড়ার খিটখিটে জেঠুদের মতো রাগারাগি করে খুব কি কিছু বদলানো যাবে? রোদ্দুর রায়কে না হয় গ্রেফতার করা গেলো, চাবকে পিঠের ছাল ইত্যাদি তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের ধার্য করা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকা আরও অনেক বিধানের যেকোনো একটি দেওয়া গেলো কিন্তু তাঁদের কী করবেন যেই প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ এই রোদ্দুর কে “গুরু” মেনে বসে আছে?
মনে আছে আমাদের পাড়ায় এক বৃদ্ধা ছিলেন তাঁকে দেখলে পাড়ার ছেলেরা “খুদির মা” বলতো, সম্ভবত খুদি নামে তাঁর একটি মেয়ে ছিল। ঠিক জানা নেই। পাড়ার ছেলেরা আওয়াজ দিলেই বুড়ি কদর্য ভাষায়, অশ্রাব্য গালাগালিতে চিৎকার করতেন। তাতে ছেলেরা মজা পেতো এবং দ্বিগুণ উৎসাহে একই কাজ করতো। ক্রমশ গালাগাল এবং পাল্টা গালাগালিতে যেটা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছতো একটা সময়। ঠিক এরকমই একটা ছবি সোশ্যাল প্লাটফর্মগুলিতে দেখতে পেলাম গত কয়েকদিনে। গালিগালাজ এবং পাল্টা গালিগালাজের এক প্রতিযোগিতা। (সেটা অবশ্য এনআরসি থেকে শুরু করে ট্রাম্প সফর, ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ সবেতেই চোখে পড়েক আজকাল। যেন গালাগাল দেওয়াটাই একটা সংস্কৃতি।) পরিস্থিতিটা এমন হয়ে উঠলো যেন ‘কেন?’, ‘কী?’ এইসবের উত্তর খোঁজার কোনও দায় নেই আমাদের। যেন ‘রং বরসের’ সিজনে রাগ বর্ষানোটাই আমাদের কাছে মুখ্য। একবাউপজেলারও ভাবলাম না “রোদ্দুর রায়” নয়, ভাবা দরকার সেই প্রজন্মটাকে নিয়ে যারা রোদ্দুরকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করছে।
“কালচারাল শক” যুগে যুগে, কালে কালে এসেছে এবং গেছে। মনে আছে আঠেরো ছুঁই ছুঁই জেঠতুতো দাদা যেদিন কান ছাড়ানো আর ঘাড় অব্দি লম্বা চুল এবং একমাথা উঁকুন নিয়ে হোস্টেল থেকে বাড়িতে হাজির হয়েছিল সেদিন মা তুমুল বকে বলেছিলো বড়দা নাকি ‘হিপি’ হয়ে গেছে। শব্দটা সেই প্রথম শোনা। বলাই বাহুল্য, সেই নাস্তিক, তর্কবাগীশ বড়দা ছিল আমার এবং দাদাদের আইকন। যতই এলোমেলো আর অগোছালো হোক না কেন এই “অন্যরকম” কথা বলা, তর্ক করা দাদাটিকে আমরা “ফলো” করতাম। আজকের নেট যুগের মতো সোশ্যাল “ফলোয়ার”-এর নামের তকমাটা কেবল ছিল না। বড়দা বলতো “ইস্ট বেঙ্গল”, আমরা হাত তুলে বলতাম “ইস্ট বেঙ্গল”। বড়দা বলতো “রবি শাস্ত্রী” আমরা চিৎকার করতাম “রবি শাস্ত্রী”। কিছু না বুঝেও অনেক কিছু শুধু বড়দা বলছে বলেই ঠিক মনে হতো। সময় বদলেছে। এহেন বেপরোয়া, বিচ্ছু বড়দা আজ বিজ্ঞাপন জগতের প্রতিষ্ঠিত ও সফল চাকুরে, শান্ত-সুবোধ, বিশুদ্ধ আস্তিক এবং ঘোর সংসারী। তাঁর সেদিনের এঁড়ে তর্ক, বড়োদের শাসন আর আমাদের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে পারিবারিক আড্ডায় হাসির রোল ওঠে আজও।
বলি কী, এদিকে তো অনেক পুকুর চুরি হয়ে গেলো, রোদ্দুর রায়ের ভিডিও, মোকসা-ডোপ-কমেডির নামে রবি ঠাকুরের গানের বিকৃতি, চারটি মেয়ের পিঠ এবং বর্তমান প্রজন্মের নানাবিধ ‘হাত-পা নাড়া’ দেখে চিৎকার না করে একটু ওদের বক্তব্যগুলো শোনার চেষ্টা করলে হতো না? ওদের যে জায়গাগুলো ভুল মনে হচ্ছে সেগুলো কথা বলে ওদের মতো করে বোঝানোর একটা চেষ্টা করা কী খুব কঠিন হতো? তার বদলে যেটা করা হলো সেটা হলো ঘাঁড় ধরে ওদের ক্ষমা চাওয়ানো, ওঁদের থেকেও আরও বেশি কর্কশ, অশ্লীল এবং যৌনতামূলক কটূক্তি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে গলা ফাটানো। আপনি বা আমি নিশ্চিত তো আমাদের গলার আওয়াজ ওদের “মনে” পৌঁছলো? কিংবা এটাও কী ভেবেছি রোদ্দুর রায়ের প্যারোডি বাঙালি মননে রবি ঠাকুরের অস্তিত্ব অথবা তাঁর গানের এতটুকুও ক্ষতি করতে পারে কী আদৌ?
ইতিহাস বলছে “আমরা” “ওরা” করে কোনোদিন কোনো সমস্যার সমাধান আসেনি। আর যাঁরা রোদ্দুর রায়ের মতো কাউকে আজ ভুল করে অথবা ভুল না করেও “বড়দা” বলে মেনেছে, ভুলে যাচ্ছি তাঁরা কিন্তু আমাদেরই ছেলেপুলে। এমন তো নয় আমরা ওদের থেকে এতটাই দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছি যে ওঁদের কথা শোনার, বোঝার ধৈর্যটুকুও দেখতে পারছি না? এই প্রসঙ্গে খুব মনে আসছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “লোকহিত” প্রবন্ধের অংশবিশেষ: “লিখিতে পড়িতে শিখিয়া মানুষ কী শিখিবে ও কতখানি শিখিবে সেটা পরের কথা, কিন্তু সে যে অন্যের কথা আপনি শুনিবে ও আপনার কথা অন্যকে শোনাইবে, এমনি করিয়া সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাইবে, তাহার চেতনার অধিকার যে চারিদিকে প্রশস্ত হইয়া যাইবে এইটেই গোড়াকার কথা।” আমরা বোধহয় আজকাল আর অন্যের কথা শুনতেই চাই না। শোনার সময়টুকু, ধৈর্যটুকু, সহনশীলতাটুকু, সহিষ্ণুতাটুকু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আর তাতেই গোল বাঁধছে।