শিশির ভট্টাচার্য
টুনটুনির খুব মন খারাপ । বেজায় মন খারাপ । কিন্তু ওর মন খারাপের কথা কাউকে বলে যে মনটা একটু হাল্কা,করবে তার কোনও উপায় নেই । শুনবার কেউ নেই । সবাই খুব ব্যস্ত। এই ডাল থেকে ঐ ডালে নেচে বেড়ানোই যেন তাদের একমাত্র কাজ। কাকে মনের কথা বলা যায় , ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল বক ধার্মিকের কথা। ও যে সুন্দর বেগুন গাছটার ওপরে থাকে , ওর গাছ-বাড়ি, তার কাছেই আছে একটা ডোবা , বহুদিনের পুরনো ডোবা । সেই ডোবার পারেই বক ধার্মিক রোজ এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে। সবাই খুব মান্য করে তাঁকে ।
ভূত- ভবিষ্যৎ-বর্তমান সবই তাঁর পায়ের নখ দর্পণে । টুনটুনি ভাবল তাঁর কাছেই যাওয়া যাক। ও নিশ্চয়ই কোন পথ বাতলে দিতে পারবে। বলতে পারবে, ওর মনের কথা শুনবে । যেমন ভাবা তেমনি কাজ । টুনটুনি বকধার্মিকের কাছে এসে তার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল । বকধার্মিক তখন এক মনে মাছ ধরতে ব্যস্ত । হঠাৎ টুনটুনির দিকে চোখ যেতে , মনের সুখে মৎস্য খাই , আমার কোন চিন্তা নাই, আং আং আং বলে আরও কি সব উচ্চারণ করে বলল; আচমন, প্রক্ষালন এসব করতে করতেই দিন চলে যায় । নিজের জন্য কোন সময়ই পাই না। তা টুনটুনি চুপ কোরে বসে আছ যে ?
টুনটুনি বলল , আপনি মাছ ধরতে ব্যস্ত ছিলেন , তাই কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না । বকধার্মিক দুদিকে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল , এ কি কথা টুনটুনি, আমি ধার্মিক মানুষ , আমি কখনও আমিষ খেতে পারি ? তুমি ঠিক বুঝতে পারনি । আসলে কয়েকটা মাছের হারে ব্যথা হয়েছে বলে আমার কাছে চিকিৎসা করতে এসেছিল । এমন রোজই কোনও না কোনও মাছ চিকিৎসার জন্য আসে । তা আমি ওদের হাড়ে ছোট ছোট অস্ত্রোপচার করে আমার এই মুখের থলেতে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি । সুস্থ হলেই আবার জলে নাবিয়ে দেব। তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব সমস্যায় পড়েছ। খুব মন খারাপ। আপনি ধার্মিক লোক । আপনি তো ত্রিকালজ্ঞ , সবই জানেন ,বলল টুনটুনি।
আমার খুব মন খারাপ, কিন্তু কাউকে বলে যে একটু হাল্কা হব তার উপায় নেই। কারোর শোনার সময় নেই। আপনি যদি একটু শোনেন । আমার এত সময় কোথায় ? সবার দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতেই আমার দিন কেটে যায়। ধার্মিক হওয়া কি সহজ কথা? তা হলে আমায় একটা উপায় বাতলে দিন। বকধার্মিক একটু ভেবে বলল, তুমি বরং নদীর কাছে যাও । নদীর কোন কাজ নেই। ও নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবে ।
নদীটা ওর বাড়ি থেকে একটু দূরেই । অনেক দিন আগে নদীর পারে মার সঙ্গে পাখিদের এক উৎসব দেখতে গিয়েছিল । কি মজাই না হয়েছিল। মা সঙ্গে থাকলে সব সময়েই কত মজা হয় । আজ একা একা নদীর ধারে এসে ওর একটু ভয় ভয় করছিল । একদিকে মানুষের ভিড়, তারা নৌকায় নদী এপার ওপার করছে । নৌকা বোঝাই করে নানা ধরনের মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। কি তাদের বাহার আর কীই বা তাদের রঙ । কতরকম খেলার জিনিসও রয়েছে । মানুষ বড় মজার জীব। ঐ খেলনাগুলোর মধ্যে নানা রঙের নানা ঢঙের খেলনা পাখিও রয়েছে। ও একটু নির্জন অথচ ঝোপঝাড় আছে , এমন জায়গা বেছে নিয়ে নদীর পাড়ে এসে বসল। মা বারবার সাবধান করে দিয়েছে, মানুষের কাছাকাছি না যেতে। মানুষ পাখিদের খাঁচায় আটকে রাখে, বিক্রি করে দেয় , মেরেও ফেলে ; পাখির মাংস খেতে ওরা নাকি ভীষণ ভালবাসে। মানুষরা ভীষণ নিষ্ঠুর !
টুনটুনি মন খারাপ নিয়ে নদীর পারে এসে বসল । নদীকে এবার মন খারেপের কথা বলতে হবে । নদী কি তার মনের কথা শুনবে ? ও কান পেতে শুনল
কুল কুল ধ্বনিতে নদী বয়ে চলেছে। কোথায় চলেছে কে জানে ! কিন্তু নদী যেন অনেক পাল্টে গেছে। আগের মত স্বচ্ছ নয় , কেমন যেন ঘোলাটে। নদীরও কি মন খারাপ ? ওরই মতো ? টুনটুনি বলল, আমার মন খারাপ , খুব মন খারাপ। নদীও বলল , আমার মন খারাপ , খুব মন খারাপ। কেন? কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। কেউ আমার মনের কথা শুনতে চায় না, কেউ আর আগের মত গান শোনায় না। এক সময় ছিল মাঝিরা কি সুন্দর ভাটিয়ালি গান গাইত। এখন নৌকার বদলে লঞ্চ চলে, স্টিমার চলে। নোংরা তেল আর কালিতে ভরে যায় আমার জল। আর কি পুরনো দিন ফিরে আসবে, ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।
টুনটুনি বলল, আমারও কত দুঃখ। নদী তুমি কি আমার মনের কথা শুনবে ?সময় কোথায় ? দেখছ না আমি সাগরের দিকে ছুটে চলেছি। টুনটুনি হতাশ হয়ে বলল আমাদের সবার মন খারাপ । আমরা কেউ কারো কথা শুনতে চাই না । কারো সময় নেই। কিন্তু আমাকে যে মনের কথা বলতেই হবে । কে শুনবে আমার মনের কথা ? টুনটুনি ভাবল আবার বকধার্মিকের কাছে যাই । ও নিশ্চয়ই কারো হদিশ দিতে পারবে।
টুনটুনি মন খারাপ নিয়ে আবার বকধার্মিকের কাছে ফিরে এল। বকধার্মিক বলল, কি টুনটুনি মন ভাল তো ? নদী তোমার কথা শুনল ? না, ওর সময় নেই কারো কথা শোনার । ওরও খুব মন খারাপ। ও এ জন্য সাগরের কাছে যাচ্ছে । বকধার্মিক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল তুমি বরং মরুভূমির কাছে যাও। ওর তো কোথাও যাবার তাড়া নেই, আমার মনে হয়, ও নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবে। এই শুনে টুনটুনি খুশি হয়ে মরুভূমিতে চলল। বেশ কিছুটা যাবার পর মনে হল, আরে ও তো জানে না মরুভূমি কোথায়,
কীভাবে সেখানে যেতে হয়। বকধার্মিককে জিজ্ঞাসা করা হল না। এবার উপায় ? ভাবতে ভাবতে খুব ক্লান্ত হয়ে এক সময় একটা কাটাগাছের ঝোপে ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ অদ্ভুত এক বাজনা শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখল অনেক লোক সার সার উটের পিঠে চড়ে কোথায় যেন চলেছে। খুব রঙচঙের বাহারে পোশাক তাদের। কিছু লোক সবার আগে আগে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে নাচতে নাচতে চলেছে। একটি উটকে বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে । সেই উটের ওপর মণি মুক্তা খচিত সিংহাসনে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে রাজারানি সেজে বসে আছে। ছেলেটির কোমরে এক বিশাল তরবারি আর মেয়েটির কোমরে মিনের কাজ করা সুদৃশ্য কিংখাবে একটি ছোট ছুরি মুখ বের করে হাসছে যেন।
ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বললেও মেয়েটি যেন একটু উদাসীন । কোন কথাই শুনছে না। টুনটুনির খুব অবাক লাগল। এত সুন্দর রাজা রানি; কিন্তু রানির মন কোথায় ? ও ভাবল একটু কাছে গিয়ে দেখা যাক, ব্যাপারটা কি ? ফুড়ুৎ করে উড়ে কাছে যেতেই দেখল রানির দুচোখে কি যেন চিক চিক করছে। ওমা , রানি যে কাঁদছে ! এত সুন্দর রাজা এত সুন্দর রানি। তবু রানি কাঁদছে কেন ? তবে কি রানির মন খারাপ ? রানির মন খারাপের কথা শোনার কেও নেই ; তাই কি রানি কাঁদছে ? ও একটু কাছে যেতেই রানি ওকে দেখতে পেল।
হঠাৎ হেঁসে রাজাকে কি যেন বলল। মুখ দেখে মনে হল রানি ওইখানে টুনটুনিকে দেখে একটু অবাক হয়েছে। রাজা ফিরে তাকাতেই ও ভয় পেল। ওকে নিশ্চয়ই ধরে আনার জন্য লোক পাঠাবে। এখন কি করবে ও ? পাশে একটা বড় কাঁটা গাছের ঝোপ দেখে তার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। ভয়ে শরীরে কাঁটা দিলেও রানিকে দেখার কৌতূহল মিটছিল না। কাঁটাঝোপের ফাঁক দিয়ে সে রানিকে দেখছিল। মনে হোল রানি বুঝতে পেরেছে, ওর ভুলের জন্য টুনটুনির খুব বিপদ হতে পারত। তাই টুনটুনিকে না দেখতে পেলেও, সে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল ।
রানির চোখের জল আর মলিন মুখের কথা সে কোনোমতেই ভুলতে পারছিল না । হঠাৎ সর সর শব্দ হতেই ওর চমক ভাঙল । ও বাবা এটা কোন জায়গা ? চারদিকে খালি বালি আর বালি। ওকি তাহলে মরুভূমিতে পৌঁছে গিয়েছে ?
যতদূর চোখ যায় বালি বালি আর বালি। বাতাস সমানে বলে চলেছে সর সর। চতুর্দিকে বালির ঝড় বয়ে চলেছে। আর সেই ঝড়ের তাড়নায় বালিগুলো দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে। এক জায়গায় জড়ো হয়ে কোথাও তৈরি করছে বালির পাহাড় , কোথাও বিশাল প্রাসাদ।
টুনটুনি একটু অবাক হোল । ও তো ঘুমিয়ে ছিল । মরুভূমিতে এল কখন ? তাহলে ওকি স্বপ্ন দেখছে ! রাজা , রানি ; রানির দুঃখ । এ সব তো স্বপ্ন হতে পারে না । তাহলে, তাহলে কি ঘুমের মধ্যে উড়তে উড়তে এখানে পৌঁছে গেছে । এমন সময় আকাশের দিকে চোখ গেল । একটা বিশাল পাখি উড়ে আসছে, লক্ষ্য তার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে পাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়ল ।
মরুভূমিতে এত বিপদ তার জানা ছিল না। বকধার্মিক তাকে এ সব কথা কিছুই বলেনি। এর মধ্যে ও মন খারাপের কথা কাকে জানাবে , কি করে জানাবে ? হঠাৎ করে ঝড় থেমে গেল । চোখে পড়ল সার সার উট মিছিল করে কোথায় চলেছে । কি তাদের পোশাকের বাহার, তাতে কত রঙের কারু কাজ করা।কয়েক জন মানুষ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে । তাদের মাথায় ইয়া বড় পাগড়ি । রঙিন কুরতা।শূরতলা জুতো । কারো হাতে সারেঙ্গির মত বাদ্য যন্ত্র ।কেউ কেউ আবার হাত পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে কালোয়াতি সুরে কীসব গেয়ে যাচ্ছে।
দেখে খুব হাসি পাচ্ছিল । টুনটুনি ভাবল সবাই তো আনন্দেই আছে , কিন্তু ওর এত মন খারাপ করে কেন ? এইসময় এক খন্ড মেঘ অনেক দূর পর্যন্ত ছায়ায় ঢেকে দিল । ও ভাবল নিশ্চয়ই মরুভূমির মন খারাপ হয়েছে , নইলে মুখ এত ম্লান হতে পারে না।
ও চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি মন খারাপ হয়ে গেল মরুভূমি ? কি বললে, মন খারাপ ? মরুভূমি হেসে বলল, সময় কোথায় মন খারাপ করার ! দেখছ না আমার কত কাজ। সবটা জুড়ে আমাকে আলপনা আঁকতে হচ্ছে , পাহাড় তৈরি করতে হচ্ছে, প্রাসাদ তৈরি করতে হচ্ছে।
আমার মন খারাপের কথাটা একটু শুনবে ? টুনটুনি প্রায় কান্নার সুরে বলল । কত দূর থেকে আমি এসেছি , আমার মনের কথা শোনাতে এলাম, আমার কথাটা একটু শোনো না ভাই মরুভূমি ! আমার এখন একদম সময় নেই। এই বলে মরুভূমি সর সর শব্দে যেন বয়ে চলল। বালি বাতাসে উড়তে লাগল । টুনটুনি চেয়ে দেখল সমস্ত মরুভূমির বুকে কি সুন্দর আলপনা আঁকা হয়ে যাচ্ছে।
টুনটুনির মন আরও খারাপ হয়ে গেল । কারোরই সময় নেই তার মনের কথা শোনার। কাউকে তার চাই-ই, যে তার মন খারাপের কথা শুনবে । ও আবার ফিরে চলল বকধার্মিকের কাছে।
টুনটুনিকে দেখতে পেয়ে বকধার্মিক বলল, এবার নিশ্চয়ই তুমি তোমার মন খারাপের কথা বলতে পেরেছ। টুনটুনি ম্লান মুখে বলল, কারোরই সময় নেই আমার কথা শোনার । এবার আমি কার কাছে যে যাই ? বকধার্মিক কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবল। এরপর বলল , তুমি বরং পাহাড়ের কাছে যাও। পাহাড় তো চুপচাপ বসে থাকে । ওর বোধ হয় তেমন কাজ নেই । ও নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবে । টুনটুনি খুশি হয়ে বলল, তাহলে পাহাড়ের কাছেই যাই, আমার মন খারাপের কথা বলে একটু হালকা হতে পারব ।
গভীর জঙ্গল আর নদী পেরিয়ে টুনটুনি যখন পাহাড়ের কাছে পৌঁছল, তখন।সকাল হয়ে গিয়েছে। ক্লান্ত শরীরে একটা ছোট গাছের ডালে বসে ওপরের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল । পাহাড় এত সুন্দর ! চূড়ায় চূড়ায় সাদা তুলোর মত বরফ, যেন পাহাড়ের সম্রাট মুকুট পড়ে সূর্যকে আবাহন করছে । সবুজ গাছে গাছে রঙবেরঙের ফুল ফুটে আছে। পাখিদের কুজনে মুখর বনভূমি । ছোটো ছোট
ছেলেমেয়েরা নানা রঙের সুন্দর পোশাক পরে গান গাইতে গাইতে স্কুলে যাচ্ছে । দূরে বৌদ্ধ মন্দিরে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজছে।
সকালের সূর্যের আলোয় আর চতুর্দিকে মনোরম আলোর ছটায় এ এক স্বপ্নের দেশ বলে মনে হচ্ছে। এ কোন্ মন ভাল করা দেশে ও এলো ? মনে মনে ভাবল এখানেই থেকে যাবে। তাহলে মন খারাপের কথা কাউকে আর শোনাতে হবে না। সে এখন খুশি খুশি আর খুশি ! ঠিক সেই মুহূর্তে ধীর গতিতে বিশাল এক মেঘ ভেসে এল। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। পাহাড়ের উজ্জ্বল স্বর্ণ শিখর কোথায় হারিয়ে গেল।গাছের পাতা, বাতাস সবই যেন বৃষ্টি ভেজা । টুনটুনি শীতে কাঁপতে কাঁপতে একটি ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নিল। একটু ভয়ও পেল। ভাবল পাহাড়ের নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে।পাহাড়ের সেই হাসি মুখ কোথায় গেল। কিছুক্ষণ পরে ও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, পাহাড় তোমার কি মন খারাপ হয়ে গেল। আমার তো সব সময়ই মন খারাপ থাকে । কাউকে বলতে পারি না। কেউ শুনতে চায় না।কারও সময়ই নেই। তোমার কি একটু সময় হবে।
পাহাড় হেসে বলল, বল, নিশ্চয়ই শুনব । টুনটুনি বলল, আমার ভাল লাগে না, কাউকে ভাল লাগে না , মাকে ভাল লাগে না, বন্ধুদের ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না , কিছু করতে ভালো লাগে না.——- । পাহাড় বলল, থাম থাম । এত না না কোরো না । তোমার মত আমার যখন বয়েস ছিল আমারও এমনি মনে হত। কাউকে ভাল লাগত না। ধূপ গাছ, ম্যাগনোলিয়া ফুল, সার সার পাইন গাছ, আকাশ, মেঘের দল, রঙবেরঙের জামা পরে স্কুলে যাওয়া, খুদে বন্ধুদের, কাউকে না।
তার কারণ কি জান ? আমি কি করবো, কি করতে চাই, ভেবেই পেতাম না। কি ভয়ানক সমস্যা বল তো ! কেউ শুনতে চায় না, আমার সমস্যাটা বুঝতে চায় না। অনেকেই হাসে। তারপর একদিন আমি আমার মনের মত কাজগুলো খুঁজে পেলাম ; ছোট ছোট গাছগুলোকে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগলাম, ফুল ফোটানোর সময় ঠান্ডা বাতাস বয়ে আনতাম। আমার এখানে সেখানে কত কিছুর চাষ হয়। তাদের জলের জোগান দিতাম, উষ্ণতা দিতাম যাতে তারা ফসল হয়ে উঠতে পারে ।
কমলা ,আনারস আরও কত রকমের ফলের বুক মিষ্টি রস দিয়ে ভরে দিতাম। এমনি আরও অনেক কাজ। তুমিও কি করতে চাও, তাই নিয়ে ভাব। যেমন ধর, ফুল ফোটানোর কাজ, তোমার বাড়ির পাশে যে ছোট্ট দুষ্টু মেয়েটা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে চায় না , এজন্য স্কুলে রোজ দেরি হয় , গান গেয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া । মার সঙ্গে দুষ্টুমির খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে মজা করা, এমনি কত কি ! টুনটুনির মনে হোল , তাই তো ! কতদিন ও মার কাছে কোন দুষ্টুমি করে না, মা যখন ওকে টুন বলে ডেকে আদর করে , ওর কতই না মজা লাগে ; বুলবুলি, ফিঙ্গে, চড়ুই ,আরও পাখি বন্ধুরা যখন ওকে চড়ুইভাতির নেমন্তন্ন করে , সারাদিন কেমন করে কেটে যায় বুঝতেই পারে না।
পাহাড় ঠিক কথাই বলেছে , ও এতদিন কি করবে তাই ভেবে পাচ্ছিল না , এ জন্যই তার এত মন খারাপ ছিল। ও খুব খুশি হয়ে পাহাড়কে বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ । আমি আমার কাজ খুঁজে পেয়েছি। আমার আর মন খারাপ নেই । আমি এক্ষুনি ফিরে গিয়ে অনেক অনেক কাজ করব, মার কাছে আব্দার করব , বন্ধুদের সঙ্গে মজার খেলায় মাতব। বিদায় বন্ধু !
পাহাড় বলল, শোন , তুমি এখানে আলো ঝলমল দিন দেখেছ, আবার অন্ধকার , বৃষ্টি ভেজা বাতাসে আতঙ্কিত হয়েছ । মনে রেখ , আলো আছে , আবার অন্ধকারও আছে। ভাল লাগা আছে ,আবার খারাপ লাগাও আছে । তাই নেই নেই নয় । সব সময় আলোর দিকে চোখ রেখো, মনের মত কাজ খুঁজে নিও, সকলের পাশে থেকে তার কথা শুনবে, বন্ধুদের প্রাণ খুলে ভালোবাসবে আর যদি কখনো ভুল করে মন খারাপ হয়ে যায় , আমার কাছে চলে এসো । বিদায় বন্ধু ! টুনটুনি বলল , বিদায় ! বিদায়!
টুনটুনি খুশি মনে বাড়ি ফিরে চলল। টুনটুনির মন খারাপের গল্পও এখানে শেষ হোল।