পুলক মিত্র: প্রায় ৪ বছর আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন মুকুল রায়। তৃণমূলে ছিলেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই ছিল তাঁর স্থান। দলীয় প্রার্থীদের টিকিট দেওয়া থেকে শুরু করে সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব, সবই সামলাতেন।
কিন্তু বিজেপিতে? না, এত বছর কাটিয়েও তিনি গেরুয়া শিবিরের ঘরের লোক হয়ে উঠতে পারলেন না। একুশের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সোমবার বিজেপির নতুন রাজ্য কমিটির যে তালিকা প্রকাশ করা হল, তাতে একটা বার্তা স্পষ্ট। তা হল, মুকুল রায় যেমন আছেন, তেমনই থাকুন। দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে না।
তৃণমূল ছেড়ে আসা ৩ জনকে নতুন কমিটিতে রাখা হয়েছে। এঁরা হলেন বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্ত , ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং এবং বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। এর মধ্যে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন সৌমিত্র। তাঁকে করা হয়েছে বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতি। অন্যদিকে, অর্জুন সিংকে দলের সহ সভাপতি এবং সব্যসাচীকে সম্পাদক করা হয়েছে।
এঁরা সবাই মুকুলের অনুগত, এখন তা জোরগলায় বলা যাবে না। তৃণমূলে থাকাকালীন মুকুলের সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। পরে অবশ্য তাতে কিছুটা প্রলেপ পড়ে। এবং তা অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থে। মুকুলের হাত ধরে সব্যসাচী বিজেপিতে এসেছিলেন। একসময় সব্যসাচীর বাড়িতে গিয়ে মুকুলের লুচি-আলুর দম খাওয়া নিয়েও বিস্তর চর্চা হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু এখন সব্যসাচীর সঙ্গে বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। একসময়ের কংগ্রেসী সৌমিত্র খাঁ-কে তৃণমূলে এনেছিলেন মুকুলই।
কিন্তু অতীতের সম্পর্কের সেই সমীকরণ এখন বদলে গেছে। কারণ, অবশ্যই রাজনীতিতে টিকে থাকার লড়াই। এটা আজ কারোর নয় যে, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে মুকুলের সম্পর্ক ততটা মসৃণ নয়। একসময় দিলীপবাবু বলেছিলেন, মুকুল কোনও বড়মাপের নেতাই নন। আর রাজ্য বিজেপিতে এখন দিলীপ ঘোষেরই একাধিপত্য। মুকুল ভেবেছিলেন, তাঁর ছেলে শুভ্রাংশুকে যুব মোর্চার দায়িত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
বিজেপিতে এখন মুকুলের পদমর্যাদা বলতে, তিনি দলের জাতীয় পরিষদের সদস্য মাত্র। এর বেশি কিছু নন। একসময় তাঁকে কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হবে, এমনটাও শোনা গিয়েছিল। কৈলাস বিজয়বর্গীয়র সঙ্গে তাঁর যতই ঘনিষ্ঠতা থাক, রাজ্য বিজেপিতে এই মুহূর্তে মুকুলের তেমন গুরুত্ব নেই। নানা ঘটনাক্রম থেকে তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
এ নিয়ে বিজেপির অন্দরমহলের খবর হল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সামনে রেখে রাজ্য বিজেপির সর্বেসর্বার হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন মুকুল, যা দলের পুরনো নেতাদের মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। রাজ্য বিরোধিতার আঁচ পেয়েই মুকুলকে সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রেখেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
অন্যদিকে, তৃণমূলে বড়সড় ভাঙন ধরানোর যে কৌশল মুকুল নিয়েছিলেন, তাও খুব একটা কাজে আসেনি। তাছাড়া, তৃণমূল ভাঙানোর খেলায় এখন খুব একটা আগ্রহী নন বিজেপি নেতৃত্ব। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দলের ভাবমূর্তির প্রশ্নও।
তৃণমূল ছাড়ার পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মুকুলকে বিজেপিতে যোগ দিতে হয়েছিল। তাঁকে নেওয়ার ব্যাপারে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তিনি বিজেপিতে যোগ দিতে সক্ষম হন।
গত লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসনে জিতেছে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে। তাই দ্বিতীয়বার তাঁকে দলের রাজ্য সভাপতি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই রাজ্যে অন্তত দিলীপ ঘোষকে এড়িয়ে বিজেপি নেতারা কিছু করবেন না, তা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কী করবেন মুকুল? বলতে গেলে, রাজনৈতিক জীবনের গুরুতর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মন চাইলেও এই মুহূর্তে বিজেপি ছাড়তে পারবেন না। কারণ, বিকল্প কোনও পথ খোলা নেই। আর বিজেপিতে থাকতে হলে, এভাবে গুরুত্বহীন হয়েই থাকতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে তিনি যে জাতীয় স্তরে কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবেন, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।