পবিত্র সরকার
জর্জদার কথা আমি যখন ভাবি তখন আমাদের যৌবনের কথা মনে পড়ে । ১৯৫০- ৬০এর মধ্যে আমরা যৌবনে পৌঁছেছিলাম।
সে এক আশ্চর্য সময়। ওই দশক থেকে শুরু হল বহুরূপী, লিটল থিয়েটার এবং অন্যান্য দলের নাটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক এঁদের ছবি আসতে শুরু করল। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা ব্যানার্জি প্রভৃতি গায়ক আমাদের মাতিয়ে তুললেন।
জর্জদা ছিলেন একটু প্রান্তিকতায় নির্বাসিত । রবীন্দ্র শতবার্ষিকী বছরের আগে তাঁর একটি একক রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল, আর কনক দাসের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীতের একটি। কিন্তু তাতেই আমরা যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল্য আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছিলাম তারা খেয়াল রাখছিলাম ওঁর গানের সম্পর্কে। তার কারণ, গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তাঁকে সমাদর করে নিয়ে যেতাম।
একটা হাস্যকর কথা মনে পড়ছে। গান গাইবার জন্য তাঁকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা দিতাম তখন। তাও পাঁচ টাকা কমানোর জন্য ঝোলাঝুলি করতাম। জর্জদা হাসি মুখে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে তাঁর মোটর সাইকেলে চড়ে চলে আসতেন এবং গান গেয়ে আমাদের মাতিয়ে দিতেন।
বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী জর্জদাকে তুলনামূলক অস্পষ্টতা থেকে বিশাল জনপ্রিয়তার বিশাল প্রাঙ্গনে নিয়ে এল। এর আগে চলচ্চিত্রে পঙ্কজ মল্লিক বা কানন দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছেন এবং গ্রামোফোনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবু আমরা বলব ক্যাসেটের যুগে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উপলক্ষ করে জর্জদা যে ভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, তার তুলনা নেই।
তাঁর নিজস্ব গায়কী-গলার নাটকীয়তা, তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ, যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাব ও সুরকে মূর্তি দিয়ে তুলে আনল। এই গায়ন ভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বর আমাদের কাছে এতই স্বতন্ত্র ছিল যে , তাঁর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যতখানি পাওয়া যেত, তা যেন অন্যদের কাছে ঠিক সে ভাবে পাওয়া যেত না ।
ফলে অনেকগুলি গান জর্জদা যে ভাবে গেয়েছেন , তেমন ভাবে গাওয়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরেও আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে কি না জানি না।
সে সব গানের তালিকা খুবই দীর্ঘ , তবু ইতস্তত মনে পড়ছে এই গানগুলি – তুমি রবে নীরবে , মহারাজ এ কি সাজে , আমার যে দিন ভেসে গেছে , বহু যুগের ওপার হতে , চিনিলে না আমারে কী , মন যে বলে চিনি চিনি, তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি, বড় আশা করে এসেছি…।
জর্জ দার জন্মদিনে আমার অনন্ত প্রণাম।
দেবব্রত বিশ্বাসের নিজের হাতে অনুবাদ ও তাঁর আঁকা ছবি।
সৌজন্য : দেবব্রত বিশ্বাস স্মরণ কমিটি।