দেবদাস কুণ্ডু
কতো লেখক কতো শিল্পী
এঁকেছেন মানুষের ছবি
গঙ্গা অজুর্ন বিবর
আমি দেখেছি মানুষ সুন্দর।
সেদিন ছিল সিলেট রঙের আকাশ। দরজার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমি। উদাসীন এক যুবক। ভাবছি এই জীবন নিয়ে কি করি। বি. কম. পাশ তো হলো। এবার কি করবো? বাবা তাঁর ব্যবসা দেখার কথা বলছে। আমি রাজি নই।
সামনে বাইশ ফুটের রাস্তা। গাড়ি যাচ্ছে আসছে। লোক চলাচল করছে। হঠাৎ একটি মেয়েকে দেখে আমি ডেকে উঠি, “এ যে শুনছো” মেয়েটি শোনেনি। এগিয়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বললাম, “তুমি তো চিত্তরঞ্জন কলেজে পড়?”
“হ্যাঁ। কি হয়েছে?”
“আমি ঐ কলেজ থেকে এবার বি কম পাশ করেছি।
“ভালো কথা। আমাকে বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে চিনি না।”
“আমি সুদিন। এই বাড়িতে থাকি? তুমি তো পনের নম্বর থাকো?”
“হ্যাঁ। আমার নাম জ্যোৎস্না। এখন বলুন কেন ডাকলেন?”
“মানে এখন তো আমি বেকার। ভাবছি টিউশন করবো।”
“ভালো তো। তাই করুন।”
“তুমি যদি একটু সাহায্য করো?”
“আমি? কি ভাবে?”
“তুমি তো কমার্স নিয়ে ভর্তি হযেছো?”
“হ্যাঁ। আমার স্যার আছেন।”
“সে থাক। তোমার যদি কোন বন্ধু থাকে আমার কাছে পাঠাও খুব ভালো হয়?”
“হঠাৎ আমাকে কেন এমন মনে হলো?
“দেখেছি তোমার অনেক বন্ধু আছে। তাই।”
“আচ্ছা। কেউ যদি বলে পাঠাবো আপনার কাছে।”
দিন পনের পর দুটি ছেলে এসে বলল. “আপনি সুদিন?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“আমরা কমার্স পড়বো। জ্যোৎস্না আমাদের পাঠিয়েছে।”
“কে জ্যোৎস্না?”
“মানে? আপনি চেনেন না?”
‘ না তো!
“যা:বাবা। ব্যাপারটা কি হলো? পনের নম্বর থাকে। চিত্তরঞ্জন কলেজে পড়ে।”
“হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে। ছি ছি! আমি একদম ভুলে গেছিলাম। তোমরা কিছু মনে করো না।”
শুরু হলো দুটো ছাত্র নিয়ে টিউশন। তারপর জ্যোৎস্না আরও ছাত্র পাঠিয়েছে। ছাত্ররা আবার ছাত্র নিয়ে এসেছে। কোচিং জমজমাট হয়ে গেল। বাইরে একটা সাইনবোর্ড দিলাম। নাম : সাফ্যলের ঘর।
কিন্তু জ্যোৎস্নাকে কিছু একটা দিতে হয়। ওর অবদান তো ভোলার নয়। নীরবে আমাকে সাহায্য করেছে। ভুলি কি করে? খুব যে সুন্দরী তা নয়। কিন্তু একটা হালকা লাবণ্য আছে মুখ জুড়ে।
বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় ওকে নিমন্ত্রণ করলাম। তখনও দেরি পুজোর। জ্যোৎস্না অনেক স্বাভাবিক। খোলামেলা খুব ভালো লাগছে। ছাদে এসেছে জ্যোৎস্না। আপন মনে গান গাইছে। গলাটা দারুণ।
না না গো না,
করো না ভাবনা-
যদি বা নিশি যায়, যাব না যাব না
যখনই চলে যাই, আসিব বলে যাই,
আলো ছায়ার পথে, করি আনাগোনা।।
আমি কেমন বিমোহিত হয়ে বললাম, “আমি তোমায় ভালবাসি জ্যোৎস্না। এই আজ এখন মনে হলো।”
জ্যোৎস্না গান থামিয়ে আমাকে দেখলো অনেকক্ষণ। তারপর দূরের দিকে চোখ রেখে বলল, “সামনের মাসে আমার বিয়ে। আমাকেও তোমার ভালো লেগেছে। আমরা বন্ধু হতে পারি।”
আজ এসেছি জ্যোৎস্নার বাড়ি। ও হুইল চেয়ারে বসে গান গাইছে। আজও সেদিনের মতো ছাদ জুড়ে জ্যোৎস্না।
গলায় সুর, গানের কথা-
এসো এসো প্রাণে মম, গানে মম হে।
এসো নিবিড় মিলন ক্ষণে রজনী গন্ধার কাননে,
স্বপ্ন হয়ে এসো আমার নিশীথিনীতে–
ফুটবে যখন মুকুল প্রেমের মঞ্জুরীতে।।
গান থামিয়ে জ্যোৎস্না বলল, “খুব মনে পড়ছিল তোমার কথা। কেন সেদিন তোমায় ফিরিয়ে দিলাম। পড়েছিলাম ছেলের দুর্ঘটনায় মৃত্যু আছে। জোতিষীর কথা বিশ্বাস করিনি। সত্যি হলো সে কথা। একই দুর্ঘটনায় সে মরে গেল। বেঁচে গেলাম আমি। কিন্তু এই বেঁচে থাকা কি বাঁচা?
মানুষ অনেক রকম ভাবে বাঁচে। সবার বাঁচা তো একরকম নয়। তুমি যে গান গাইছো এতো বেঁচে থাকার কথা। এখনও তোমার ভিতর প্রেম রয়েছে।
জ্যোৎস্না চুপ।
“শোন তোমাকে যে ভালোবেসে ছিলাম। সেই ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে আমার বুকের মাঝে।”
“তুমি নেবে আমায় সুদিন। আমি যে বড় একা। একদিন তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আজ ভিখিরির মতো চাইছি।
“শোনো জ্যোৎস্না প্রেম কখনো মানুষকে ভিখিরি করে না। প্রেমে মানুষ হয় সম্রাট।”