(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর-এর কলমে।)
হীরক কর : আজকে জামশেদপুরের একটি মেয়ের গল্প বলব। অনেক সময় প্রেমে পড়ে মানুষ ভালো হয়। জীবনের যাত্রাপথ তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু এখানে হয়েছে উল্টো। প্রেম এখানে তাকে খুনি তৈরি করে ছেড়েছে।
একটা বাড়ি। তার ওপরে একটা ছাদ। সেই ছাদের নিচে ২৩ ঘন্টা। আর ২৩ ঘণ্টার মধ্যে চার চারটি খুন। আর চারজনই নিজের আপনজন। প্রথম খুনের পর ৩-৪ ঘণ্টা অপেক্ষা, দ্বিতীয় খুনের জন্য। তারপর আবার কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা। তৃতীয় খুনের জন্য। চতুর্থ শিকার ঘরের বাইরে ছিল। তার জন্যেও অপেক্ষা করতে হয়।
২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৯। জামশেদপুরের ভেতর টেলকো বলে একটা এলাকা আছে। সাধারণত টেলকো কারখানার কর্মচারীরাই সেখানে থাকেন। সেখানে ভৌমিক বলে একটি বাঙালি পরিবার থাকতো। ২৯ জানুয়ারি দুপুরে ভৌমিকদের বাড়িতে সবমিলিয়ে তিনজন ছিলেন। ছিলেন গৃহকর্তা ভৌমিকের স্ত্রী, শাশুড়ি, একমাত্র কন্যা চৈতালি।
চৈতালির ঠাকুমা দুপুরের খাওয়া সেরে ওপরে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চৈতালির মা নিচেই ছিলেন। সব শহরে বাড়ির কর্তা বা ছেলেরা অফিস চলে গেলে দুপুরে খাওয়ার পর মহিলারা সাধারণত দু এক ঘন্টা বিশ্রাম নেন। সেইরকমই ঠাকুমা উপরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চৈতালির মা নিচে ঘরের সব কাজকর্ম সামলে নিজের ঘরে শুতে গেছিলেন। কিন্তু ঠাকুমা এবং মা জানতেন না, ওই বাড়ির বাগানে আরেকজন লুকিয়ে আছে। ওই ব্যক্তি হলেন চৈতালির নিজের স্বামী রিজওয়ান খান।
মা এবং ঠাকুমা বিশ্রাম নিতে চলে গেলে চৈতালি দরজা খুলে দেয়। চুপচাপ বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসে রিজওয়ান। সে সরাসরি চলে যায় ওপরের ঘরে। দুপুর গড়াচ্ছিল সন্ধের দিকে। চৈতালি আস্তে আস্তে ওপরে উঠে আসে। দেখে ঠাকুরমা শুয়ে আছেন। রিজওয়ানকে ঠাকুমার ঘরে ইশারায় ডেকে আনে। দুজনে মিলে ঠাকুমার গলা টিপে ধরে।
যখন মনে হয় ঠাকুরমা মারা গেছে, তখন রিজওয়ান সঙ্গে করে আনা চপার দিয়ে ঠাকুরমাকে কয়েক টুকরো করে। ঠাকুমার লাশ কম্বল দিয়ে মুরে দেয়। কেননা জানুয়ারি মাস, বেশ ঠাণ্ডা ছিল জামশেদপুরে। সব বাড়িতেই কম্বল, লেপ, গরম জামা কাপড় বের করা হয়েছিল। রিজওয়ান ওপরেরই একটা অন্য ঘরে লুকিয়ে পড়ে। নিচে মা ঘরের কাজ করছিলেন। তারপর আরাম করার জন্য শুতে যান।
চৈতালি পা টিপে টিপে নিচে নেমে আসে। রিজওয়ানকে ডাকে। মা কিছু বলার আগেই দুজনে মিলে মায়ের গলা টিপে ধরে। ঠাকুমার মতো মাকেও চপার দিয়ে টুকরো টুকরো করে। এরপর মায়ের লাশও কম্বলে মুড়িয়ে বিছানায় লুকিয়ে ফেলে। চৈতালির মায়ের নাম ছিল অনিতা ভৌমিক ওরফে লাকি।
পরপর দুটো খুন হয়ে গিয়েছিল ভৌমিক বাড়িতে। এই দুটো খুন হয়েছিল দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে। চৈতালির ছোট ভাই বাইরে ছিল। সন্ধে হতেই সে বাড়ি ফিরে আসে। ভাই বাড়ি ফিরতেই তাকে দুজনে মিলে চেপে ধরে। শ্বাসরোধ করে। চপার দিয়ে কোপায়। লাশের টুকরোগুলো একটা কম্বলে মুড়িয়ে রেখে দেয়। তিনটি খুন ততক্ষণে হয়ে গেছে।
সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরেন চৈতালির বাবা। তার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল চৈতালি এবং রিজওয়ান। তিনি ঘরে ঢুকতেই রিজওয়ান শ্বশুরের গলা চেপে ধরে। আগের তিনটে খুনের মতোই চপার দিয়ে ওনার লাশও টুকরো করে দেয়। বাড়ির ভিতরে চার-চারটে খুন হয়ে গেছে। কিন্তু সবটাই প্রতিবেশীদের অজানা।
চারটি খুন করার পর স্বামী স্ত্রী মিলে ওই বাড়িতেই থাকে। পুরো রাত কাটায়। পরদিন সকাল হতে বাড়ির সমস্ত ঘর পরিষ্কার করে। পিছনের বাগানে একটা ম্যানহোল ছিল। ম্যানহোলের মধ্যে এক এক করে চারটি লাশের টুকরোগুলো ঢুকিয়ে দেয়। ম্যানহোলের ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। তারপর দিন, ১ ফেব্রুয়ারী রিজওয়ান বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। চৈতালি ওই বাড়িতেই থাকে, যে বাড়িতে কয়েক ঘণ্টা আগে সে চার চারটি খুন করেছে। খুন করেছে ঠাকুরমা, মা, ভাই এবং বাবাকে। তার কোনওরকম ভয়ডর ছিল না। তিন চার দিন পর প্রতিবেশীদের সন্দেহ হয়। মিস্টার ভৌমিক অফিসে যাচ্ছেন না। চৈতালির মা লাকিকে দেখা যাচ্ছে না। ভাই পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে বেরোচ্ছে না। তাঁরা চৈতালিকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার বাবা-মা কোথায় ? যথারীতি চৈতালি বলে, বাবা মা ভাইকে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। কয়েকদিনের মধ্যে চলে আসবেন।
চৈতালি ওই বাড়িতেই থাকতে থাকে। একদিন হঠাৎ সে ওই বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে যায়। প্রতিবেশীরা দেখেন ঘরের বাইরে তালা লাগানো। চৈতালি উধাও হবার আগে রিজওয়ান বাড়িতে আসে। বাড়ির পিছনের ম্যানহোলের ঢাকনা সিমেন্ট দিয়ে আটকে দেয়। যাতে কেউ ম্যানহোল খুলতেই না পারে। এরপর চৈতালি ঘর থেকে উধাও। বাড়ির সদর দরজায় ঝুলতে থাকে তালা।
এরকমভাবে ছ’মাস চলে যায়। ৬ মাস ধরে ওই বাড়িতে তালা লাগানো ছিল। প্রতিবেশীদের কেমন কেমন লাগছিল। ভৌমিকরা কোথাও গেলে পাশের বাড়ির লোকদের জানিয়ে যেতেন। কিন্তু এবার কিছু বলে যাননি। ছ’ মাস হয়ে গেল তারা ফিরলেন না। চৈতালি বাবা মা আত্মীয় বাড়ি গেছেন বলে উধাও হয়ে গেলো। তবুও তাদের মনে হলো হয়তো আত্মীয়র বাড়িতে কোন কারণে ভৌমিক দম্পতি ব্যস্ত হয়ে গেছেন।
এদিকে মিস্টার ভৌমিক টেলকোর অফিসে ডিউটি করতে যাচ্ছেন না। ছ’মাস ধরে অফিসে আসছেন না। কর্তৃপক্ষ খোঁজখবর শুরু করলো। ৬ মাস পেরিয়ে যায় কিন্তু কেউ ভৌমিক পরিবারের খোঁজ পান না।
ছ’মাস পরে চৈতালির এক মামা ডাক্তার অনুপম রায় বেশ কয়েকবার ফোন করেন। মোবাইল ফোন বন্ধ পান। ভৌমিক বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে ফোন বেজে যায়। কয়েকবার ফোন করার পরও যখন সাড়া পাওয়া যায় না, তখন ডাক্তার অনুপম রায়ের চিন্তা হয়। কেননা ছ’মাস ধরে বোনের সাথে কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। জামাইবাবুর অফিসে ফোন করলে অফিস থেকে বলা হয় মিস্টার ভৌমিক ছ’মাস ধরে অফিসে আসছেন না।
তখন ডাক্তার রায়ের সন্দেহ হয়। তিনি কলকাতা থেকে জামশেদপুর পৌঁছান। বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখেন তালা বন্ধ। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই বলতে পারেন না। তারা বলেন, ভৌমিকরা জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ। আর অনুপম যখন জামশেদপুরে পৌঁছেছেন তখন জুন মাস। প্রতিবেশীরা বলেন, চৈতালি বলেছিল, কোন আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে ভৌমিকরা গিয়েছেন। অনুপম বলেন, এই ছয় মাসে তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান ছিল না। থাকলে আমার জানার কথা থাকতো।
অবাক হন প্রতিবেশীরা। অনুপম জানতে চান শেষ পর্যন্ত বাড়িতে কে ছিল? প্রতিবেশীরা জানান, চৈতালি। প্রথমে মিস্টার ভৌমিক, তার স্ত্রী, তার মা এবং ছোট ছেলেকে দেখা যাচ্ছিল না। তার পরেও ১০ দিনের ওপর ওই বাড়িতে দেখা যাচ্ছিল চৈতালিকে। চিন্তিত হয়ে পড়েন অনুপম। পায়চারি করতে করতে পৌঁছে যান বাড়িটির পেছনের দিকে। আচমকা তার নজর পড়ে ম্যানহোলের ঢাকনার ওপর। কেমন যেন অন্যরকম লাগে। পুরো ম্যানহোলের ঢাকনাটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। তার মনে হয় ছ’মাস ধরে ঘর বন্ধ। কিন্তু ঘরের সামনে ম্যানহোলের ঢাকনা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধালো কে? এবং মনে হচ্ছে সিমেন্ট লাগানো একেবারে নতুন। এটা তাঁর কাছে আশ্চর্য লাগে।
ডাক্তার সটান স্থানীয় থানায় চলে যান। বলেন, ছ’মাস ধরে তার বোন, ভগ্নিপতি, ভাগ্নে, ভাগ্নি, নিখোঁজ। পুলিশও বৃত্তান্ত শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ভৌমিকদের বাড়িতে আসে। প্রতিবেশীদের সামনে ডাক্তারকে নিয়ে বাড়ির সদর দরজার তালা ভেঙে ফেলে। ঘরের ভিতরে ঢুকে অদ্ভুত একটা গন্ধ পায়। কিছু কিছু জায়গায় ছিল রক্তের ছোপ। কিছু জামা কাপড়ে লেগে ছিল রক্ত। দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। পুলিশ যখন গোটা বাড়ি তল্লাশি করছিল, সেই সময় ডাক্তার অনুপম বাড়ির পেছনে ওই ম্যানহোলের কাছে এসে পৌঁছান। খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যানহোলটা দেখেন। পুলিশকে বলেন, বাড়ি যদি তালা বন্ধ থাকবে তাহলে কে এসে এই ম্যানহোলে সিমেন্ট লাগিয়ে গেল? পুলিশেরও ব্যাপারটা সাধারণ মনে হয় না।
ঠিকা লেবার ডেকে সিমেন্ট ভেঙে ম্যানহোল খোলা হয়। ঢাকনা সরতেই ভেতর থেকে দুর্গন্ধ ভেসে আসে। শ্রমিকরা ম্যানহোলে ঢুকে তল্লাশি করলে এক এক করে মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বেরিয়ে আসে। দেখা যায় এগুলো চারটি মানুষের দেহের টুকরো। কিন্তু বাড়িতে ছিলেন ৫ জন লোক। তাহলে চারজন মানুষের দেহাংশ মিলল কেন? প্রতিবেশীদের বয়ান অনুযায়ী ভৌমিক দম্পতি চলে যাওয়ার পরও চৈতালিকে ওই বাড়িতে দেখা গিয়েছিল আট দশ দিন ধরে। মানে চৈতালি বেঁচে আছে, বাকিরা কি মারা গেছে? প্রশ্ন হল, ঠিক আছে পরিবারকে কেউ আক্রমণ করে খুন করলে সবাই মারা গেলেও চৈতালি কিভাবে জীবন্ত বেঁচে গেল? তবে কি চৈতালিকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে ?
পুলিশ তদন্ত শুরু করে কিন্তু কোন সূত্র মেলে না। ফরেনসিক টিম ডাকা হয়। তাঁরা ভৌমিকদের ঘর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত তদন্তকারীদের সন্দেহ চৈতালির ওপর এসে আটকে যায়। কিন্তু কোনো প্রমাণ মেলে না। না অপহরণের টাকা চেয়ে ফোন । না ভৌমিক পরিবারের সঙ্গে অন্য কারো শত্রুতা ছিল।
পুলিশ চৈতালির প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে খোঁজখবর শুরু করলে জানা যায়, রিজওয়ান খান বলে রাজ্য স্তরের এক ক্রিকেটার আছে, যার সঙ্গে চৈতালির গভীর সম্পর্ক ছিল। পরিবার এই সম্পর্ক মানতে পারছিলেন না। পুলিশের সন্দেহ আরও গভীর হয় যখন রিজওয়ানের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় না। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় টিম পাঠায়। কিন্তু কারো হদিস মেলে না। দুজনেই উধাও। পুলিশ বুঝতে পারে চৈতালি একলা নেই। তার সঙ্গে রিজওয়ান আছে।
তল্লাশি, খোঁজখবর চলছিল। একদিন আচমকা চৈতালি রিজওয়ান আদালতে গিয়ে সারেন্ডার করে দেয়। এ খবর পেয়ে পুলিশ আদালতে যায়। কোটের কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে তাদের নিজেদের হেফাজতে নেয়। হেফাজতে নিয়ে ম্যারাথন জেরা করলে এক এক করে সমস্ত কাহিনী প্রকাশ্যে আসে। ভৌমিক পরিবারের একমাত্র কন্যা চৈতালি শুরু থেকেই স্বাধীনচেতা। তার জন্য বাবা-মা প্রায়ই বকাঝকা করতেন। পড়াশোনায় মন ছিল না।
ওর বাবা টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং লোকোমোটিভ কোম্পানি অর্থাৎ “টেলকো”তে কাজ করতেন। চৈতালি ওই সময় জামশেদপুরের সেক্রেট হার্ট কনভেনশন স্কুলে পড়তো। ওই স্কুল জামশেদপুরের কিরণ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, যেখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ম্যাচ পর্যন্ত হয় তার পাশেই। ওই স্টেডিয়ামে রঞ্জি, স্টেট লেভেল ক্রিকেটাররা প্র্যাকটিস করতেন। চৈতালির ক্রিকেটের শখ ছিল। টিভিতে ইন্ডিয়ার ম্যাচ একটাও ছাড়তো না। মাঝে মাঝে স্টেডিয়ামে গিয়ে প্র্যাকটিস দেখতো। ওখানেই ঝাড়খণ্ডের একজন প্রতিশ্রুতিবান ক্রিকেটার ছিল রিজওয়ান। বলা হয়, তার ভবিষ্যতও ছিল উজ্জল।
রিজওয়ান খানকে প্র্যাকটিস করতে দেখতে দেখতে চৈতালি তার প্রেমে পড়ে যায়। তাদের বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব গড়ায় ঘনিষ্ঠতায়। তারা দুজনে স্থির করে বিয়ে করবে। দু’জনেই ছিল প্রেমে অন্ধ। তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। চৈতালি তখনও বাড়ির লোকদের কিছু জানায়নি। এরইমধ্যে চৈতালি আচমকা প্রেগনেন্ট হয়ে যায়। যখন গর্ভবতী হয়। তখন বাড়ির লোকদের একথা লুকোনো মুশকিল হয়ে পড়ছিল। গোপন কথাটি আর গোপন থাকেনি। তার গর্ভাবস্থার কথা মা-বাবা জেনে যান। ওই সময় চৈতালি এবং রিজওয়ান গোপনে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে। কাউকে কিছু জানায়নি। এই বিয়ের কথা শুধুমাত্র তারা দুজনেই জানতো। ধর্ম পাল্টে চৈতালি নাম নেয়, শেহনওয়াজ ।
কিন্তু বাড়িতে একদিন জানাজানি হয়ে যায়। এই নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি করেন বাবা-মা। বাবা তাকে বোঝান, তাদের পরিবারের মেয়ে ভিন্ন ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না। তারপর কোর্ট ম্যারেজ বাতিল করতে বলেন। বলেন, যদি রিজওয়ানের সঙ্গে বিয়ে টিকে রাখিস, তাহলে সম্পত্তি থেকে তোকে বঞ্চিত করা হবে। সব সম্পত্তি পাবে ভাই।
চৈতালির মাথা বিগড়ে যায়। তার মনে হয়, বাড়ির লোকেরা সব তার শত্রু। তাকে সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হবে। মেয়ের ভালোর জন্য বাবা-মা বোঝালে সেটাই মেয়ের মগজের মধ্যে হয়ে ওঠে বিষ। চৈতালি সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের প্রেমের রাস্তায় আসবে তার নাম নিশান মিটিয়ে দেবে। এ ব্যাপারে সে রিজওয়ানের সঙ্গে কথা বলে। নিজের বাবা-মাকে খুন করার জন্য প্রেমিককে প্রস্তুত করে। রিজওয়ান তার কথা মেনে নিলে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, গোটা পরিবারকে নিকেশ করে দেবে। ২৯ জানুয়ারি তারা সুযোগ পেয়ে যায়। এক এক করে ঠাকুরমা, মা, ভাই, বাবাকে খুন করে।
এরপর এই মামলা আদালতে যায়। জামশেদপুরের নগর দায়রা আদালত ২০০১-এর ১৩ মার্চ এই মামলার রায় দেয়। রিজওয়ান এবং চৈতালিকে ফাঁসির সাজা শোনায়। কেননা আদালতের ধারণা, এটা রেয়ারেস্ট অফ দ্যা রেয়ার কেস। জামশেদপুরে হইচই পড়ে যায়। ফাঁসির সাজার বিরুদ্ধে চৈতালি ও রিজওয়ান ঝাড়খন্ড হাইকোর্টে আপীল করে। হাইকোর্টে দু’বছর ধরে শুনানি চলে।
২০০৩-এর ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্ট ফাঁসির সাজাকে বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এই সাজার বিরুদ্ধেও তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। আরো তিন বছর সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলার পর সুপ্রিম কোর্ট ঝাড়খন্ড হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার পর রিজওয়ান চৈতালিকে হাজারিবাগ জেলে পাঠানো হয়। যখন চৈতালি তার পরিবারের সবাইকে খুন করেছিল, তখন সে ছিল গর্ভবতী। গ্রেফতারের পর গর্ভবতী অবস্থাতেই জেল খাটতে থাকে সে। জেলের হাসপাতালেই সে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।
জেল কোডের নিয়ম অনুযায়ী কোন বাচ্চা জেল হাসপাতালে জন্মালে তাকে মায়ের সঙ্গে জেলেই থাকতে হয়। বিনা অপরাধে জেল খাটার অদ্ভূত নিয়ম। কিন্তু জেলে এই শিশুটি বড় হতে থাকে। জেলে নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চার বয়স ছ’বছরের বেশি হয়ে গেলে তাকে আর মায়ের সঙ্গে জেলে থাকতে দেওয়া হয় না। তাই,একসময় তাকে লালন পালন করার জন্য চৈতালির এক আত্মীয় জেল থেকে নিয়ে যান। সেই পুত্র এখন প্রায় ১৯ বছরের।
সে এখন কোথায় আছে ? কি করছে? কিছুই জানা নেই। কিন্তু এখনো হাজারিবাগ জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটছে চৈতালি-রিজওয়ান। রিজওয়ানের বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেছে। চৈতালিরও জীবনে অনেক কিছু করার ছিল । নিজের কম বয়সের নির্বুদ্ধিতায় জীবন নষ্ট করেছে সে। এক পুত্র, যে কোনও দোষ করেনি। কিন্তু বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাবা মা জেলে। জেলের বাইরে ছেলে। আর এক কন্যা, যাকে বাবা-মা বিস্তর ভালোবাসতেন। তাদেরই খুন করে ফেলে সে। এই হল সম্পর্কের আলাদা আলাদা চেহারা।
এখান থেকে অনেক শিক্ষা পাওয়া যায়, প্রথমত, বাবা মা যখন সন্তানদের কিছু বোঝান, বকাঝকা করেন, সেটা তাদের ভালোর জন্যই। কারণ অভিজ্ঞতা থেকে বাবা-মায়েরা সন্তানের কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ বোঝেন। কিন্তু সন্তান যদি তাতে বাবা মাকে খারাপ ভাবে, মনে করে তার শত্রু, তবে এই মস্তিষ্ক বিগড়ানোর কোনো সমাধান নেই।