দেবস্মিতা নাগ
সব উৎসবই বাঙালির কাছে কম বেশি খাদ্যোৎসব।চেটেপুটে ডান হাতের বন্দোবস্ত না থাকলে এবং শেষ পাতে মধুরেণ সমাপয়তে না হলে ঠিক যেন জুত হয় না। মনে হয় যেন আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। হ্যাঁ, আট থেকে আশি যে কোনও বাঙালিই এটা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাবেন না, তাই কাল বিলম্ব না করে সরাসরি দোলের দিন বাঙালির পাতে কী কী মিষ্টি পড়ে, আর ইতিহাসের কোন সময় থেকে পড়ে আসছে, সেটা দেখে নেওয়া যাক।
বসন্ত উৎসবে বুঁদ বাঙালি আবির মেখে যে মিষ্টিগুলি দিয়ে মিষ্টিমুখ সারেন,সেই সাত মিষ্টির কথা এখানে তুলে ধরলাম।
১. মঠ : মঠের ইতিহাস সুপ্রাচীন। দোল পূর্ণিমায় রাধামাধবের প্রসাদের থালায় বাতাসা কদমার মাঝখানে সাজানো মন্দিরের চূড়ার আকারের মিষ্টিটাই হলো মঠ। সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর শতবর্ষ প্রাচীন লেখায় গ্রামের দোলতলায় মিষ্টির দোকানে মঠ বিক্রির বর্ণনা করে গেছেন।
প্রকৃতপক্ষে মঠ হলো পর্তুগিজ মিঠাই। হুগলির ব্যান্ডেল চার্চে প্রথম এই মিষ্টি প্রভু যিশুর প্রসাদী থালায় পাওয়া যায়। পরে বাঙালি ময়রারা পরম স্নেহে মঠকে বাঙালি বানিয়ে ফেলেছেন। তাকে গোলাপি, হলুদ, লাল নানান রঙে রাঙিয়ে দোলের আঙিনায় ছেড়ে দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে ফেলেছেন। চিনির কড়া পাক দিয়ে সেই সান্দ্র তরল কাঠের ছাঁচে জমিয়ে বা ফুটো পাত্রের ভিতর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ফেলে এই মঠ প্রস্তুত করা হয়। এটি ৫-৬ সেন্টিমিটার উঁচু একটি শুকনো ও অত্যন্ত পরিচিত মিষ্টি।
২. ঠান্ডাই : বাঙালি আবির ছাড়াও বোধহয় দোলটা কোনোমতে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ঠান্ডাই ছাড়া কদাচ নয়। ঠান্ডাইকে তরল মিঠাই বলা যেতে পারে।দুধ, মালাই, দই,ফলের রস, বাদাম বাটা, ড্রাই ফ্রুট ইত্যাদি সহকারে তরিবৎ করে বানিয়ে উপরে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দোলের নাটে আসে এই ঠান্ডাই। একে ছাড়া দোল হয় না এ বঙ্গে।
৩. পেরাকি : যদিও অবাঙালি গুজিয়া নামটাই আজ বেশি প্রচলিত, তবু এর সাবেকি নাম কিন্তু পেরাকি।হ্যাঁ, সুপ্রাচীন বাঙালি মিষ্টি এটি। বিশেষ করে দোলেরই মিষ্টি। দোলের দিন বাংলার ঘরে ঘরে মা মাসিমারা বহু যুগ ধরে বানিয়ে আসছেন এই মিঠাই।
খোয়া ক্ষীরের সাথে ময়দা, আমন্ড কুচি, দারুচিনি, এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে পুর তৈরি করে সেই পুর ছোট ছোট লেচিতে মুড়িয়ে, সেই পিঠেগুলি দুধের শিরায় জাল দিয়ে তৈরি হয় পেরাকি। গুজিয়া শুকনো হলেও পেরাকি রসালো কিন্তু। দোলের শেষ পাতে এর বাঁধা জায়গা।
৪. মালপোয়া : ইনি হলেন বঙ্গ হেঁসেলের সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। ঝটপট তৈরি করা যায় এই মিষ্টি।সাড়ে চুয়াত্তর সাক্ষী আছে বাঙালি মাসিমারা এই মিষ্টিতে কতটা পটু। দোলের দিন কে কখন বলবে “মাসিমা মালপো খামু”, তাই মাসিমাদের ভাঁড়াড়ে এ মিষ্টি তৈরি করাই থাকে।
৫. লবঙ্গলতিকা : এর স্বত্ব কোনো ভাবেই ছাড়বে না বাঙালির বসন্ত উৎসব। দোলের শেষ পাতে একচেটিয়া অধিকার এই ময়দা ও চিনির পাকের মিষ্টির। এই মিষ্টি দোকানে ছাড়াও দোলে বাংলার ঘরে ঘরে বানানো হয়।
৬. বাদামের লাড্ডু : বাঙালির দোলের পাতে ইনি বয়েসে তরুণ। তবে জনপ্রিয়। কাজু, পেস্তা, আমন্ড, আখরোট সব রকম বাদাম বাটা ঘি ও চিনির কড়া পাকে কষিয়ে এই লাড্ডু তৈরি করা হয়। এই মিষ্টি কিনে খাওয়ার চলই বেশি।
৭. দানবাকৃতি মিষ্টি : সবশেষে যে মিষ্টির কথা হচ্ছে, পল্লীবাংলার বিভিন্ন দোলের মেলায় সেটির দেখা মেলে। কখনো এর ওজন ৫ কেজি, কখনো ৭ কেজি। সাধারণত ১-২-৩ কেজি ওজনের মিষ্টিগুলির বিক্রি বেশি হয়। অপূর্ব সুস্বাদু এই মিষ্টিগুলি কিলো কিলো ছানা ও ময়দার পাকে চিনির শিরায় দিয়ে বানান সুদক্ষ ময়রারা। এগুলির প্রণালী সবটা তাঁরা বলেন না। কিছুটা রহস্য।
পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী এক নম্বর ব্লকের রায় দোগাছিয়া গ্রামের জমিদার রায় চৌধুরীদের দোল মঞ্চের বিশাল মেলায় এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যায়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষের ঢল নামে এই মিষ্টি দেখতে। এক একটি রসগোল্লা এক একটি ফুটবলের মত বড় ও এক একটি চমচম মানুষের হাতের মত বড় হয়। তৈরি হয় বিশাল বিশাল ল্যাংচাও।
এসে গেছে বসন্ত। দোলও এসে গেছে। মিষ্টির প্রস্তুতির তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেছে বাঙালির ঘরে ঘরে, অলি গলির দোকানে। বাংলা মেতে উঠবে মিষ্টিমুখের উল্লাসে।