সন্দীপ ব্যানার্জি
কোভিড-১৯ কালীন বিশ্বে অনেক পরিবর্তন আমরা দেখছি এবং দেখবো। জনজীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত। বলাই বাহুল্য, শিক্ষাও এর বাইরে নয়। বর্তমান অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ভীষণ বিপর্যস্ত। শিক্ষাকক্ষে শিক্ষাদান সম্ভব নয় বলে তা তো আর থেমে থাকবে না। তাই ইতিমধ্যে আমাদের শিক্ষাদানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন পন্থা খুঁজে বের করতে হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠদানের পদ্ধতি শুরু হওয়া থেকে একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তা প্রচলিত হয়েছে। একজন শিক্ষক উপস্থিত থেকে ছাত্রকে পড়াচ্ছেন, এটাই সবথেকে প্রচলিত ও সমাদৃত। এতে যে শুধু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যাখ্যাদান হয় তা নয়, একজন শিক্ষক তাঁর বক্তব্য ও উপস্থিতির মাধ্যমে ছাত্রকে অনুপ্রাণিত করেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটান। এবং সে কারণেই শিক্ষাদানকে যথার্থভাবে মানবসম্পদ উন্নয়ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আজকের দিনেও শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা ( classroom teaching) সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়, কিন্টারগার্ডেন স্তর থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সবই পরিবর্তনশীল। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেই যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন দিক খুলে গেছে এবং বর্তমান শিক্ষণ পদ্ধতি এই প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। বর্তমানে গোটা বিশ্ব এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চলেছে, তা হল “অর্ন্তজাল” বা ওয়েব (web) মাধ্যম যা শিক্ষার প্রযুক্তিকেও প্রভাবিত করেছে। শিক্ষার তিন মূলনীতি হল : সুযোগ, সাম্য ও গুণমান। এই তিনটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে ই-এডুকেশন এক নতুন পথের দিশারী। পরিবর্তন হলো একমাত্র ধ্রুব এবং মানবসভ্যতার ইতিহাস মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।
“Without contrary there is no progression.” শিক্ষাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরনোপন্থীরা সবসময় শ্রেণিকক্ষকেই মান্যতা দেন শিক্ষার পাঠদানের ব্যাপারে। কিন্তু অনলাইন শিক্ষাকে আর ব্রাত্য ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এটা এখন এক বিশ্বব্যাপী ঘটনা। সারা পৃথিবীর ছাত্ররা এর সুবিধা উপলব্ধি করে তার সুফল তুলছে। এর বেশ কিছু সঙ্গত কারণ আছে। ভালো করে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, অনলাইন শিক্ষামাধ্যমে এক ধরনের নমনীয়তা আছে, যা পাঠদানকে অনেক সহজে অনেক বেশি শিক্ষানবিশের কাছে পৌঁছে দেয়। যে সকল ছাত্র প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষার সুযোগ থেকে নানা কারণে বঞ্চিত তারা ই-শিক্ষার মাধ্যমে নিজেরা শিক্ষার আঙিনায় বিরাজমান থাকতে পারে, কেতাবি ও বৃত্তিমূলক উভয় শিক্ষাক্ষেত্রেই। এই শিক্ষার মাধ্যমে বাড়িতে বসেই পাঠ নেওয়া সম্ভব।
যেখানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেখানে অনায়াসে অনলাইন শিক্ষা পাঠদান করছে। পরিস্থিতি ও অবস্থান নির্বিশেষে শিক্ষার প্রসার অগ্রসর হচ্ছে। কারণ অতি সহজেই শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব দূর হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষণ পরিণতি বা “learning outcome” মানদন্ডে বিচার্য যার মূল লক্ষ্য ছাত্রদের পাঠ গ্রহণের সুবিধা প্রদান করা।
ছাত্রেরা পাঠ গ্রহণের সময় বা পাঠের ব্যাপ্তি নিজেদের মতো করে গড়ে নিতে পারে। তারা দরকার মত পরীক্ষা নির্ঘণ্ট বেছে নিতে পারে। এমন অনেক ছাত্র আছে, যারা জীবিকার তাগিদে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা চালাতে পারে না। ই-শিক্ষা তাদের এই ঘাটতি মেটাতে বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে।
ই-শিক্ষা এক ধরনের ফলতো শ্রেণিকক্ষ (virtual classroom) নির্মাণ করে, যার দ্বারা ছাত্রদের শারীরিক অনুপস্থিতি শিক্ষাদানকে ব্যাহত করে না। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো এখনকার সময়। আজকের এই করোনা আক্রান্ত বিশ্বে সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাদানকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
ভারতের মতো দেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা সংকুচিত। আর এ ব্যাপারে অনলাইন শিক্ষা একটি বিরাট আশীর্বাদ। শিক্ষাক্ষেত্রে এ একধরনের গণতান্ত্রিক বিকাশ, কারণ ছাত্রদের উপস্থিতি সব সামাজিক শ্রেণী থেকে হতে পারে এবং বেশি সংখ্যায় হতে পারে। আজকাল বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ICT বা Information and Communication Technology Classroom আছে, যেখানে ইন্টারনেটের সাহায্যে ছাত্ররা যে কোনো বিষয়ের বিবিধ বিশ্লেষণের উপকারিতা কাজে লাগাতে পারে। ছাত্ররা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো বিষয়ের ওপরে জ্ঞান ও তথ্যের রসদ সংগ্রহ করতে পারে। অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমের দ্বারা কোন নির্দিষ্ট পাঠক্রমের আন্তর্জাতিক শংসাপত্র ও শিক্ষা যোগ্যতা লাভ করা সম্ভব এবং তাও নিজের দেশে বসে। ভারতবর্ষে পেশাগত শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে ই-শিক্ষা যথেষ্ট ফলোদায়ী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।
ই-শিক্ষার জনপ্রিয়তা ও ব্যাপ্তির বৃদ্ধির সাথে একটি বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে। তাহলে কি আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপযোগিতা হারিয়ে গেছে? কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে, অনলাইন শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি কার্যকর পরিপূরক। বর্তমান শিক্ষার উন্নতি সাধনে এই দুই শিক্ষা মাধ্যমের সার্থক মেলবন্ধন কাম্য। আজকে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব শ্রেণির পাঠক্রমে ইন্টারনেট অপরিহার্য। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অনেক পরিবর্তন দেখবে, যার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ই-শিক্ষার প্রভাব ও প্রসার একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যদিও এই শিক্ষামাধ্যমের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবুও আমাদের সবাইকে এই পরিবর্তনকে আবাহন করে নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিশ্চয়ই থাকবে, তার নিজের স্থানে ও মহিমায়। কিন্তু ই-শিক্ষা তার সম্প্রসারণ ঘটাবে। এর দ্বারা শিক্ষাদান তার উৎকর্ষতার উদ্দেশ্য ও দর্শন- দুইই লাভ করবে, জ্ঞান এবং দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়ে।