হোমরাজ্যসমুদ্র সৈকতে জুঁই ফুলের গন্ধের খোঁজে

সমুদ্র সৈকতে জুঁই ফুলের গন্ধের খোঁজে

সমুদ্র সৈকতে জুঁই ফুলের গন্ধের খোঁজে

সুদীপ মাইতি
ইয়াস আসছে। চারিদিকে সাজো সাজো রব। দিঘা থেকে যখন তিনি ৩৫০ কিমি দূরে অর্থাৎ ১৮-২০ ঘন্টা দূরে, তখন বেরিয়েছিলাম জুঁই ফুলের গন্ধ খুঁজতে। দিঘা থেকে ৩২ কিমি আগে কাঁথির কাছে বাঁকিপুটের সমুদ্র সৈকতে। সেখানে দেখা হলো অনির্বাণ নামে এক যুবকের সঙ্গে। বললো, আপনি ৩২ কিমি দূরে নেই। নটিক্যাল দূরত্ব ২২-২৩ কিমি হবে। আর যেখানে ওই ইয়াস সমুদ্র থেকে ধামরার কাছে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তার থেকে ৪৫-৫০ কিমি দূরে আছেন। তাই সাবধান।

বললাম, তাই তো জুঁই ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। তার অবাক হওয়া মুখ দেখে বললাম, আমি ইয়াসের কথাই বলছি। ওমান দেশ এই প্রবল ঝড়ঝঞ্জার নামকরণ করেছে ‘ইয়াস’। ওই দেশে এই নামের মানে হচ্ছে ‘দুঃখ’। অথচ ইংরেজিতে এর অর্থ জেসমিন। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় জুঁই। আর তাই খুঁজতে এসেছি।

বাঁকিপুটের সমুদ্র উপকূলে দুপুরে যখন পৌছলাম, তখন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কখনো বৃষ্টি থেমে মেঘের কোলে ভেসে আসছে আলো। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে, আদি অনন্ত দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। যেদিকটায় আকাশ থেকে আলো পড়েছে, দূরে সেদিকের সমুদ্রের রং একরকম। আবার যেদিকে ঘন মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে, সেদিকের জলের রং অন্যরকম।

দেখা হলো সমুদ্র বাঁধের একদিক আজ সকালের জোয়ারে ভেঙে জল ঢুকে পড়েছে স্থল ভাগের দিকে। তাই বালির বস্তা ফেলে তা দ্রুত মেরামতির চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন। যদিও এটা কতক্ষণ বাঁচবে, তা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। কিন্তু সে তো একদিক। অন্যদিকে চোখে পড়লো সমুদ্র বাঁধের নিচে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। তাঁরা কিন্তু তাঁদের দৈনন্দিন রুটিন নিয়ে ব্যস্ত। তাঁরা টিভি দেখছেন না। রেডিও শুনছেন না। কেউ সেই বৃষ্টির মধ্যে কুঁড়ে ঘরের সামনে লাগলো পুঁই গাছটি একটি লাঠিকে অবলম্বন দিয়ে সোজা উপরের দিকে উঠতে সাহায্য করছে।

এক মহিলা বাইরে থেকে শুকনো জ্বালন কুঁড়ে ঘরের মধ্যে রেখে দিতে সচেষ্ট। কেউ বাইরে পড়ে থাকা খড়ের আঁটি গুছিয়ে নিয়ে গাইটিকে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। তাহলে? এরা আজকের দিনে জুঁই ফুলের মানে না জানুক, ইয়াস যদি নাও শোনে, তবে একটা সমস্ত প্রশাসনকে নাড়িয়ে ২৪x৭ কাঁপিয়ে যে ঝড় ঝঞ্জা আসছে তার কি কোনো খবর নেই? না, এটা ঠিক নয় বলে জানালেন চিত্তরঞ্জন ধাড়া, সুষেণ মান্নারা। বললেন, এ তো প্রতি বছর আসে।

তবে এবারে ভয়ের একটা বিশেষ কারণ আছে। রাত পোহালেই ভরা পূর্ণিমা কোটাল। সকাল ৯টা নাগাদ জোয়ার আসবে। কোটালে এমনিতেই জলোচ্ছ্বাস বেশি হয়। এই বাঁধ উপছিয়ে খুব কম হলেও কোনো কোনো সময় জল চলে আসে। বললেন ওই ঘূর্ণিঝড় যদি সমুদ্রের জোয়ারের সময় এসে উপস্থিত হয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হবে। না হলে কিছু গাছপালা, ঘরবাড়ি ভাঙবে। যা বছরে এক আধ বার তো হয়েই থাকে। কানে লাগলো কতো অবলীয়ায় তাঁরা বলে গেলেন।

মনে পড়ে গেলো নাসিরুদ্দিনের কথা। যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই রবিবারের সকালে আর এক সমুদ্র সৈকতে। কাঁথি থেকে দিঘার দিকে কিছুটা এগিয়ে মন্দারমণির কাছাকাছি। এক আদরের গ্রাম ‘আন্দামানে’। না, এটা তার পোশাকি নাম নয়। কেউ কোনো কালে সমুদ্র পাশে থাকতে গিয়ে নাম রেখেছিল। তিনি আন্দামান ফেরত কিনা সেটা গবেষণা হয়নি। পোশাকি নাম দক্ষিণ পুরষোত্তমপুর। রামনগর -২ ব্লকের মধ্যে এটি অবস্থিত।

না, গ্রাম নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। বলার আছে, নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে। নাসিরুদ্দিন থাকেন তাঁর সহধার্মিনীকে নিয়ে সমুদ্রের বাঁধের উপর একটি চার সাড়ে চারফুট উচ্চতার ‘বাড়িতে’। চারদিকে চারটে ঝাউয়ের খুঁটি। উপরে ত্রিপলের ছাউনি। সেটাকে ‘আঁটোসাঁটো’ করতে মাছ ধরার বাতিক জাল দিয়ে বেঁধে রাখা। এটাও খুব উল্লেখযোগ্য না হতে পারে। কিন্তু তিনি শোনালেন যে, আসন্ন ইয়াসের সময় তিনি থাকবেন এই ‘বাড়িতেই’। কারণ নাকি কিছু হবে না। তিনি এই বাড়িতে রয়েছেন গত দশ বছর। তিনি এই বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন প্রবল ক্ষতিকর আমফানের সময়। তিনি এখানে থেকেই দেখা করেছেন ফণী কিংবা বুলবুলের সঙ্গে।

আমার বিশ্বাস না করা বা অবাক হয়ে যাওয়া দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ঝড়ঝঞ্জার সময় সমুদ্রের জলের ঢেউয়ের গতি প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারি সমুদ্রের জল বাঁধের উপর আসবে কিনা। আর এই ফাঁকা জায়গায় ঝড় বিশেষ কোনো ক্ষতি করে না। অনেক বেশি ক্ষতি হবে শহরে বা ঘিঞ্জি এলাকায়। আর আমরা তো সেই ছোট বেলা থেকে এই ষাট বছর ধরে অনেক ঝড় ঝঞ্জা দেখলাম।

কখনো কখনো এই রকম বড় ঝড়ের সময় পুকুরে নেমে বসে থেকেছি। কারণ স্থলে ঝড় ক্ষতি করলেও জলে কোনো ভয় নেই। তিনি বলেছিলেন, “আমার কোটি টাকা নেই ,তাই মরার ভয় নেই।” এই দুদিনে ইয়াস বা দুঃখ কিংবা জুঁই ফুল আসার আগে সমুদ্র পাড়ে ঘুরে বুঝলাম, সমুদ্র পাড়ের বাসিন্দারা চিন্তায় হয় তো থাকেন কিন্তু ভয়ে নেই। তাঁরা কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে ভয়কে জয় করে নিয়েছেন। দেখা যাক তাদের জীবনে দুঃখ আসে, না জুঁই ফুলের গন্ধ তাঁদের নাকে ভেসে আসে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img