বর্ণালী জানা
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে! তাহলেই ধর্ষকের সাত খুন মাফ। এমনই আইন আসছে তুরস্কে। তার মানে বালিকা-কিশোরীদের ওপর যথেচ্ছে যৌন নির্যাতন চালাও, তারপর নাম-কা-ওয়াস্তে একটা বিয়ে করে নাও। তাহলে আইন আর তোমায় ছুঁতেও পারবে না। তারপর বউকে মারো, খেদাও…কে আর দেখতে আসছে! বিরোধীরা অবশ্য অনেক হইহল্লা করছে। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। কিন্তু শিবঠাকুরের আপন দেশ মানে তাইয়েপ এর্দোগানের দেশে বিরোধীদের এই কন্ঠস্বর চাপা দিতে আর কতক্ষণ! যে দেশে একসময় ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকায় আনা হয়েছিল সে দেশে এখন বিবাহ নামক একটা মোড়কের আড়ালে ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়ার এই প্রাণপণ চেষ্টা সত্যিই খুব নজরে পড়ে।
এবার আমাদের দেশের দিকে একবার তাকাই। মাদ্রাজ হাইকোর্টের এক মহামান্য বিচারপতিও এই একই পথে হেঁটেছিলেন। তিনিও বিয়ের শর্তে ধর্ষককে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। নাবালিকা মেয়েটিকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করার পর, এমনকি সাত বছরের সাজা হওয়ার পরও যে মানুষের (?) বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না, শুধু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আশায় সে যদি মেয়েটিকে বিয়েও করে, তবে সে বিয়ের পরিণতি যে কী হবে, তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার দরকার পড়ে না। অবিশ্বাস দিয়ে যে সম্পর্কের সূচনা, সেখানে কি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা থাকতে পারে? বিচারপতি বলেছিলেন, ধর্ষিতা মেয়েটি এখন একটি ছয় বছরের সন্তানের (সন্তানটি অবশ্যই ধর্ষণজাত) মা, অথচ কারও স্ত্রী নয়। সমাজে বাচ্চাটির কী পরিচয় হবে? অতএব সোজা সমাধান ধর্ষককে জামিন দিয়ে দাও। সে বিয়ে করুক। কিন্তু যে মেয়েটির শরীর, মন, আত্মা, ধর্ষিত হল, ক্ষত-বিক্ষত হল, রক্তান্ত হল, তার মতামত কি কেউ নিয়েছে? কেউ কি জানতে চেয়েছে, সে এমন অসম্মানের বিয়ে করতে চায় কিনা! নাকি মেয়েদের মতামতের কোনও দামই নেই। তারা এতই অসহায় যে ধর্ষক তাকে বিয়ে করছে, জেনেই বর্তে যাবে…একেবারে বলিউডের ছবির মতো! কোর্টের নির্দেশে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর (ছবি-রাজা কি আয়েগি বারাত, পরিচালক—অশোক গায়কোয়াড়) সতী-সাবিত্রীর মতো স্বামীসেবা করে যাবে। চাবুকের মার মুখ বুজে সয়ে স্বামীর মন পাওয়ার চেষ্টা করে যাবে! ছোট পর্দায়, বড় পর্দায় শুধু এমন সর্বংসহা নারীদেরই জয়গান। এমনকী উচ্চ আদালতের প্রগতিশীল বিচারপতিরাও বলবেন, মেয়েরা ফুলের মতো পবিত্র। ধর্ষণে তাদের অপবিত্র করা হয়। তাহলে ধর্ষকের শরীর অপবিত্র হয় না কেন!
কিছুদিন আগে এক আদালতে এক ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া হল। কেন? স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না থাকলেও যেদিন ধর্ষণ হয়েছিল, সেদিন নাকি ঐ মহিলা খাতায়-কলমে ঐ পুরুষটির স্ত্রী ছিল। পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু মামলা নিয়ে আলোচনা করার অছিলায় ঐ মহিলাকে ডেকে পাঠিয়ে শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়ার জন্য তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মহিলার এই কথা আদালত মানতে চায়নি। তাঁরা জানেন, শুধু আইনের কচকচি। আর পেনাল কোডের ৩৭৬ নং-ধারায় তো বলাই হয়েছে—স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও মহিলাকেই ধর্ষণ করলেই শাস্তি।
এবার একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে। এইসব একুশে আইন আমরা কেন মেনে চলব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন মান্ধাতার আমলের আইনের পরিবর্তন হবে না? মেয়েদের কাছে মাতৃত্বে্র চেয়ে কেন তার নারীত্ব বেশি মূল্যবান হবে না? ধর্ষককে বিয়ে না করে, কেন সে নিজের পরিচয়ে সন্তানকে বড় করতে পারবে না? যেদিন তারা জোর গলায় বলতে পারবে …এ শরীর শুধু আমার…আমার মন না জাগলে শরীরও জাগবে না। জোর করে তুমি শুধু শরীরেরই দখল নিতে পারো…কিন্তু আত্মাহীন, মনহীন ঐ মাংসপিণ্ডের অধীশ্বর হয়ে তুমি কি করবে পুরুষ…সেদিন হবে ধর্ষকদের প্রকৃত শাস্তি।