সায়ন্তন বিশ্বাস
অকালে পুজো, তাই অকালবোধন। শ্রীশ্রী চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, মেধস ঋষির আশ্রমে আগত রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্যকে দেবীতত্ত্ব বর্ণনার পর যে মূর্তি তৈরি করে পুজো সম্পন্ন হয়, তা এখন বাসন্তী পূজা বলে পরিচিত। এখন আশ্বিন মাসে শরৎকালে আমরা যে পুজো করে থাকি, তা হল দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন। এই দেবী মহামায়া, কাত্যায়নী, দুর্গা।
বাঙালি শুধু তার পূজার্চনার ডালি এই শরৎ-শুভ্র আবাহনে সাজায় না, বরং তার শ্রেষ্ঠ উৎসবটিকে পালন করে পরম যত্নে, পরম মমতায়। বাংলার দুর্গাপুজোর সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। দুর্গা আমাদের ঘরোয়া দেবী। তাই বাঙালির মনে দুর্গা সপরিবারে বিরাজিতা। একসময় ছিলেন বনদুর্গা পর্বতবাসিনী, পাতার আব্রুতে তার নাম হলো পর্ণশর্বরী।
শরতের এই দুর্গাপুজোর আড়ালে রয়েছে কৃষি উৎসবের নির্যাস। প্রাক-কৃষি পর্বে দুর্গা ছিলেন জনজাতির ঘেরাটোপে। তখন শেওড়াগাছকে অরণ্যবাসিনী দুর্গা সাজিয়ে পুজো করা হতো। বঙ্গদেশে কুষ্ঠ রোগ থেকে বাঁচার জন্য পুজো করা হতো রা’ল দুর্গার। সধবারা এই পুজো করতেন। শুভ্র দুর্গা নামে আরেক মূর্তিহীন দুর্গার পুজো হয় বাংলাদেশে। উত্তরবঙ্গে দ্বিভূজা, ব্যাঘ্রবাহিনী, ভান্ডারনী পুজোর প্রচলন রয়েছে, যা দুর্গারই আরেক রূপ বলে মনে করা হয়।
পুরাণ রচয়িতাদের কাছেও দেবী শস্যদেবী বলে পরিচিত। তার নামকরণও হয়েছে “শাকম্ভরী”। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও বলছে, এই দেবীর শস্যদায়িনী রূপ। তার শাকম্ভরী রূপটি ফুটে উঠে দেবী আরাধনার নবপত্রিকা বরণে। নয়টি উদ্ভিদের সপত্র শাখারূপ হচ্ছে শস্য-বধূ নবপত্রিকা।
কলাগাছকে ব্রাহ্মণী, কালো কচুগাছকে কালিকা, হলুদ গাছকে দুর্গা, জয়ন্তী গাছ কার্তিকী, বেলশাখা শিবা, দাড়িম শাখা রক্তদন্তিকা, অশোক শাখা শোকরহিতা, মানকচুর গাছ চামুণ্ডা, ধানগাছ লক্ষ্মী। এরা নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই নয়টি গাছকে অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে, যুগ্মবেল দিয়ে তার স্তনযুগল রচনা করে পরিয়ে দেওয়া হয় লালপেড়ে শাড়ি। এগুলির মধ্যে কলাগাছ সবচেয়ে উঁচু হওয়ায় তার মাথা টেনে ঘোমটা দেওয়া হয়। যেন এক দৈবনারী। এই নয়টি উদ্ভিদের কোনোটির ভেষজ গুণ আছে, আবার কোনোটির রয়েছে খাদ্যগুণ।
সপরিবারে দুর্গার যে বাহনদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় পেঁচা, সাপ, ময়ূর, ইঁদুর, হাঁস, বাঘ বা সিংহের উপস্থিতি জনজাতির totem-কেই সূচিত করে। কৃষি ও শিকার ব্যবস্থার সমন্বয়ক রূপ ফুটে ওঠে পুজোর মধ্যে।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হচ্ছে “সমস্তদেবানাং তেজরাশিসমুদ্ভবাম” অর্থাৎ সমস্ত দেবতার তেজরাশি থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। দেবীর মুখমণ্ডল নির্মিত মহাদেবের তেজে, কেশের সৃষ্টি হয়েছে যমরাজের তেজে, দেবীর বাহুযুগল বিষ্ণুর তেজে, চন্দ্রের তেজে রূপলাভ করেছে তার স্তনযুগল, মধ্যাংশের সৃজন ইন্দ্রতেজে, উরু জঙ্ঘার উৎপত্তি বরুণের তেজে, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পদাঙ্গুলি,বসুর তেজে করাঙ্গুলি, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দন্ত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধার তেজে ভ্রু, আর বায়ুর তেজে কর্ণ। নানান দেবদেবীর মারণাস্ত্র পেয়েছিলেন দেবী। মহাদেব দান করছিলেন শূল, বিষ্ণু দান করছিলেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দিয়েছিলেন শঙ্খ, অগ্নির কাছ থেকে দেবী পেয়েছিলেন শক্তিশেল, বায়ু দিয়েছিলেন তূণ, ইন্দ্র বজ্র আর ঘণ্টা, যমরাজের কাছ থেকে লাভ হয়েছিল কালদণ্ড, ব্রহ্মা দিয়েছিলেন রুদ্রাক্ষমালা ও কমণ্ডলু আর মৃত্যুদেব খড়গ ও ঢাল। সব দেবতার তেজে, সব দেবতার অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে উঠেছেন মা।
বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা কংসনারায়ণ। শ্রী রমেশ শাস্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল এই দুর্গাপুজো। তখনকার দিনে প্রায় নয় লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল এই দুর্গাপুজোয়। এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ভবানন্দ মজুমদার, জাহাঙ্গীরের সুবেদাররাও। পরবর্তীতে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ও অভিজাতদের দুর্গাপুজোর পৃষ্ঠপোষকতা করতে শোনা যায়। এরপর ইংরেজ বণিকের মানদন্ড পরিণত হয় রাজদণ্ডে। যারা একসময় ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তাঁরাই শরণাপন্ন হলেন ইংরেজদের। ইংরেজ তোষণ বাংলার রাজাদের এতটাই প্রবল ছিল যে, তার উদাহরণ পাওয়া যায় রাজা নবকৃষ্ণের দুর্গাপুজোয়। তিনি বিরাট ধুমধাম করে দুর্গাপুজো করেন লর্ড ক্লাইভের বিজয় উপলক্ষে। সেই পুজোয় নর্তকী আসর আর সুরাপানের যে খরচ তখন হয়েছিল, তা হয়তো গল্পগাথা। পুরাণে যতই ব্রহ্মণত্ব আরোপিত হোক না কেন, তৎকালীন বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছে দুর্গাপুজো ছিল বৈভব প্রদর্শনের উপায়। জমিদার এবং ধনীরা নিজেদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা করতেন অর্থব্যয় নিয়ে। জানা যায়, পুজোতে বাঈজি নাচ শুরু করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন নব্যবাবুরা।
নবমীর বলিও ছিল প্রতিযোগিতার মাপকাঠি। দশমীতে দেবীর বিদায়ে তোপ দেগে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে শেষ হতো মহানন্দের পালা।
সময় পাল্টেছে। প্রাচীনেরা দুর্গাকে যেভাবে দেখতেন, আমরা সেই দৃষ্টি হারিয়েছি। এখন দুর্গাপুজো মানেই ফিউশন ভার্সন, থিমের সমারোহ। যখন থেকে কর্পোরেট হাউসগুলো ক্লাবকে পুরস্কার দিতে শুরু করেছে, তখন থেকেই এক প্রতিমার সঙ্গে আর এক প্রতিমার প্রতিযোগিতা। অনেক সময় এসব প্রতিমার পাশে ডামি প্রতিমা রাখা হয়, পুজো করার জন্যে। “দুর্গা”, “দুর্গা” বলতে আগে শরীরে পুলক, চোখে জল, হৃদয়ে ভক্তি, আত্মাতে আনন্দ, প্রাণে বল আসতো।
জানি না কেন, শরতের সকাল খুব মিষ্টি লাগে। শরতের সকালের বলার্ক প্রাণের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া কত সুপ্ত স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।
প্রতিমা পুজো বাংলার বিশেষত্ব। এভাবে মূর্তিপূজা ভারতে আর কোথাও নেই। বেদান্তের যে তিন প্রকার পূজা-অর্চনার বিধান আছে, সেগুলি হলো – স্বরূপ উপাসনা, সম্পদুপাসনা, প্রতিকোপাসনা। আত্মার উপাসনা হলো স্বরূপ উপাসনা, দুটি বস্তুর মধ্যে কোনও সামান্য ধর্ম থাকলে, সেই ধর্মকে লক্ষ্য করে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র বস্তুর চিন্তা ও ধ্যান এর দ্বারা বৃহত্তম বস্তুর জ্ঞানলাভ ও ধ্যান ধারণার চেষ্টা করা হলো সম্পদুপাসনা আর নিম্নতর অধিকারীর জন্য প্রতিকোপাসনা বা অভ্যাস জনিত উপাসনা।
এবার বাঙালির প্রতিমাপূজাকে কিন্তু ঠিক প্রতিকোপাসনার শ্রেণীভুক্ত করা যায় না। কালি, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এদেরকে প্রতীকও বলা যায় না, অন্যদিকে সম্পদুপাসনার অবলম্বন রূপে গ্রহণ করাটাও অসম্ভব। এগুলো খাঁটি প্রতীক বা সম্পদ উপাসনা কোনোটাই নয়। এ এক অদ্ভুত মিশ্র বস্তু। আর এই অদ্ভুত মাখামাখিটাই বাঙালির ভাবুকতার বিশেষ ফল।
আদিম আরণ্যক দেবী বহু শতাব্দীর পথ পরিক্রমায় আজ বাঙালির ঘরের মেয়েতে রূপান্তরিতা। নানা বিবর্তনের মাঝে মেয়ের বাপের বাড়িতে আসাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সপরিবারে তিনি আসুন, মঙ্গলরূপিনী দেবী লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ দিন সবাইকে, এই শুধু প্রার্থনা।
সহায়ক গ্রন্থ:
১. বাঙালির প্রতিমা পূজা ও দুর্গোৎসব – বিপিনচন্দ্র পাল।
২. পূজাপার্বণের উৎসকথা – পল্লব সেনগুপ্ত।
৩. দুর্গাপূজা বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ — ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।