- স্বামী শেখরানন্দ
( পূর্ব প্রকাশের পর ) [ ১০ ও ১১ ]
স্বামীজির চিঠি পেয়ে মার্গারেট অনেক ভাবলেন।
আরো কয়েক মাস লাগলো সংসারের সমস্ত কর্তব্য শেষ করে ভারতে আসতে।
বিদায় বেলায় মা-বোন-ভাই কাঁদছে, মার্গারেট ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে ওদের দেখছেন।
হাতের মুঠোয় স্বামীজীর সেই আশ্বাসবাণী লেখা চিঠিখানি, ‘মরদকী বাত হাতীকা দাঁত… পুরুষের জবানের নড়চড় হয় না…’।
মার্গারেট মাদ্রাজ বন্দরে ২৪ জানুয়ারী ১৮৯৮ এ পৌঁছলেন।
২৮ জানুয়ারী কলকাতা বন্দরে নামলেন।
তীরে নেমে মার্গারেট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, যখন দেখলেন স্বামীজী জেটিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
মার্গারেট ভারতে আসার কয়েকদিন পরেই স্বামীজী স্বামী স্বরূপানন্দকে তাঁর নিকট পাঠালেন বাংলা শেখানোর জন্য।
স্বামীজি নীলাম্বর বাবুর বাগান বাড়ি থেকে প্রতিদিন কয়েকজন ব্রহ্মচারীকে নিয়ে বেলুড় মঠের সেই বাড়িতে আসতেন যেখানে মার্গারেট মিসেস বুল ও ম্যাকলাউডের সঙ্গে থাকতেন।
দু-মাস ধরে স্বামীজি তাঁদের মনকে উচ্চ স্তরে তুলে দিলেন।
তাঁর বাণীর সার হল, মানুষের সেবা-পূজাই একমাত্র উপাসনা যার দ্বারা সাধক, সাধনা আর সাধ্যবস্তুর সাযুজ্য ঘটে।… খাঁটি দেশপ্রেমিকের নিষ্ঠা থাকা চাই আমাদের।
এই যে হাজার হাজার জীব না খেয়ে মরছে, অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, এ দেখে কি হৃদয় কেঁপে ওঠে না ?
প্রত্যেককে বুঝিয়ে দাও যে সে ছোট নয়, সে ব্রহ্মস্বরূপ – প্রত্যেককে এ সত্য জানবার শেখবার সুযোগ দাও।
জাগিয়ে তোল দেশবাসীকে।
তাদের ডেকে বল, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত, ঝাঁপ দাও কাজে।
কাজ চাই, কাজ – এভাবে মার্গারেটকে ভারতের কাজের উপযুক্ত করে তুলতে স্বামীজী কাজ শুরু করে দিলেন।
স্বামীজীর সম্মুখে এখন দুটি কাজ।
এক, মার্গারেটকে জনসাধারণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া,
দ্বিতীয়, সংঘজননী শ্রীশ্রীমা কে কেন্দ্র করে সনাতন হিন্দুসমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় নৈকট্য স্থাপন করা।
প্রথমটির জন্য ১১ মার্চ ১৮৯৮ স্টার থিয়েটারে মার্গারেট বক্তৃতা দেন।
বিষয় ‘ইংল্যান্ডে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব।’
দ্বিতীয়় ও তৃতীয় বক্তৃতার বিষয় ছিল কালীতত্ত্ব।
সুতরাং মানব জীবন গঠনে আধ্যাত্মিকতার ভূমিকাই যে সর্বোচ্চ তা মার্গারেট তার প্রথম ভাষণগুলিতেই পরিস্ফুট করে দিলেন।
ফলস্বরূপ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক এবং প্রাচীনপন্থী গোঁড়া হিন্দু সমাজ দুদিকেই প্রচন্ড আলোড়ন উঠলো।
এরপরেই তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট লোকেদের সঙ্গে নিবেদিতার পরিচয় ঘটল।
১৭ মার্চ মিসেস বুল, ম্যাকলাউডের সঙ্গে নিবেদিতা বাগবাজারে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে যান।
প্রথম সাক্ষাতেই শ্রীশ্রীমা তাঁদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেন।
তৎকালীন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজের একজন বিধবা এই বিদেশিনীদের শুধু অন্তরের সঙ্গে গ্রহণই করলেন না, তাঁদের সঙ্গে আহারও করলেন।
সেই যুগে এই ঘটনা অভাবনীয়, এমনকি স্বামীজীও আশ্চর্য হয়ে যান মায়ের এই উদারতা দেখে।
১৮৯৮ সালের ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের উদ্যানবাটিতে মার্গারেট কে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করে ‘নিবেদিতা’নাম প্রদান করলেন।
গুরুর দেওয়া এই অসাধারণ নামটির সার্থকতা, নিবেদিতা তাঁর সমস্ত জীবন ধরে প্রমাণ করে গেছেন, নিজেকে ভগবানের শ্রীচরণে সম্পূর্ণ নিবেদন করে।
( ক্রমশ )
পৃষ্ঠা – ১৮৪-৮৫
রামকৃষ্ণ মিশন সেন্টিনারি প্রাইমারি স্কুল, বরানগর এর ভগিনী নিবেদিতার শুভ অাবির্ভাবের ১৫০তম বর্ষ পূর্তির সমাপনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পত্রিকা রশ্মি ২০১৭ হতে গৃহীত।