হোমফিচারকতটা ভয় কাটিয়ে মানুষ থাকা যায়?

কতটা ভয় কাটিয়ে মানুষ থাকা যায়?

কতটা ভয় কাটিয়ে মানুষ থাকা যায়?

সংযুক্তা সরকার সংযুক্তা সরকার

মাত্র দু-দিন হল এ-রাজ্যে লকডাউন শুরু হয়েছে। তার আগে তো আমরা নড়ে চড়েও বসিনি। ডাক্তারবাবুদের বার বার সাবধান-বাণী সত্বেও, চীন ও ইতালির হাল ভাইরাল ভিডিওতে বার বার স্বচক্ষে দেখা সত্বেও, দেদার চলেছে মল ভ্রমণ, সামাজিকতা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সব। রাজ্য সরকারের ঘোষিত লক ডাউনের পরে যেটা এসে দাঁড়িয়েছিল, চায়ের দোকানে ঠেক, পাড়ার ক্রিকেট আর একই উৎসাহে দুধ এবং জল(পড়ুন, আলকোহোল) সংগ্রহের জন্য লম্বা লাইনে। নিশ্চিত নই, তবে সম্ভবত পাঁঠার মাংসের দোকানের সামনের লাইনটাও মোটামুটি একইরকম লম্বা ছিল। বিচিত্র হল, আমরা পুজো বা বড়দিনে যা করি, বনধ হলেও তাই করি, আবার করোনার মতো ভয়ানক ভাইরাস ভয় দেখালেও ঠিক তাই করি!

আরও অনেক কিছুই করি। এই যেমন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ‘আমরা’ জনতা কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই বুঝে যাই এমন একটা লম্বা কিছু হবে। তাই সেই থেকেই বস্তা বস্তা চাল, ডাল, তেল, নুন, মাছ, মাংস, বেবি ফুড, ওষুধ কিনে বাড়িতে জমাতে শুরু করে দিই। এক সপ্তাহ অথবা একমাস যেটুকুই প্রয়োজন হোক না কেন, প্রবল স্মার্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত আমরা তো মোটামুটি একবছরের রসদ জোগাড় করে বসে আছি! গরীব মানুষের জুটুক না জুটুক, কালোবাজারি হোক নাই বা হোক, এলিট ক্লাস আমাদের আর কী বা যায় আসে। ছুটিটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে, কচি পাঁঠার ঝোল আর দিবানিদ্রায়।’ ওসব করোনা, টরোনা আমাদের কিস্যু হবে না।’ আমরা বরং মিম বানাই। রসিকতা করে কাটিয়ে দিই।তারপরে মোড়ের মুদিখানা আর চায়ের দোকান তো আছেই। ইলিয়েবিলিয়ে স্বার্থপরতার প্রদর্শনী করে, নিজেই নিজের পিঠ বাজিয়ে, প্রয়োজনে একে-তাকে ফোন করে হা-হুতাশ করে অথবা ইথার তরঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করে, আর সময়-সুযোগ পেলে একটু করিনা-করোনার আলোচনা করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে কয়েকটা দিন। কবি যেমন বলে গেছেন, ‘আছি সুখে, হাস্য মুখে, দুঃখ আমার নাই’।

আমাদের আরেকটা সমস্যা হল, আমরা কোনও কথাই মন দিয়ে শুনি না। শুনি না বা ক্লাসের অবাধ্য বাচ্চাদের মতো হয়তো শুনতে চাই না। এই যে বার বার বলা হচ্ছে একসঙ্গে না থাকতে, বাড়ি থেকে না বেরোতে, এসব কিছুই আমরা শুনছি না। প্রধানমন্ত্রী বললেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে জরুরি পরিষেবায় নিযুক্ত চিকিৎসক, স্বাস্থকর্মী, বিমান কর্মী, সাংবাদিকদের কৃতজ্ঞতা জানাতে হাততালি দিতে বা থালা বাজাতে। আমরা দলে দলে মিছিল করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ‘কী করছি?’, ‘কেন করছি?’ এসব ভাবার, জানার দায় যেন অন্য কারও। আর যাঁরা হৈহৈ করে বেরিয়ে পড়লেন, আশেপাশের ‘অনেক জানা’-কেউই কিন্তু তাঁদের বাঁধা দিলেন না। একবারও মনে করিয়ে দিলেন না, ‘তোমরা ভুল করছ’।বরং ছবি তুলে রাখতে ব্যস্ত থাকলেন। একইভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলা সত্বেও দুধটা, ডিমটা, সব্জিটা, মাছটা জোগাড় করার জন্য হন্যে হয়ে উঠলাম আমরা।এগুলো লক ডাউন চলাকালীন পাওয়া যাবে বলে বার বার সরকারি বিবৃতিতে বলা সত্বেও! আসলে নিজেদের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোনোর বড় ভয় আমাদের! পাছে একটু অসুবিধে হয়! সেটা তো হতেই দেওয়া যায় না। এমনকি দেশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি দেখা দিলেও নয়।

এই পর্যন্ত তাও দাঁতে দাঁত চেপে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এবারে যেটা শুরু হয়েছে তা স্বার্থপরতার, অজ্ঞানতার সব সীমা যেন অতিক্রম করে গেল। যার সশব্দে নিন্দা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ই রইল না। গতকাল থেকে জায়গায় জায়গায় শুরু হয়েছে, নার্স, প্যারামেডিকেল কর্মী এবং জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার। বহরমপুর, বর্ধমানে তাঁদের ভাড়া বাড়ি অবিলম্বে ছেড়ে দিতে বলেছেন বাড়িওয়ালারা, তাঁদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে আবাসনের গেট। যাঁদের ছেলে বা মেয়ে বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে ডিউটিরত, তাঁদের বাড়ি গিয়ে বলে আসা হচ্ছে ছেলে-মেয়ে যেন বাড়ি না ফেরে। অপরাধ, তাঁরা দেশের তথা রাজ্যের এই দুর্যোগের দিনে করোনা আক্রান্তদের সেবার কাজে যোগ দিয়েছেন অথবা প্রয়োজনে দেবেন। জায়গায় জায়গায় ইন্টার্নদের বাড়ি ছাড়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকী ট্যাক্সি ও উবার চালকরাও নার্স ও ডাক্তারদের হাসপাতাল ট্রিপ দেখলেই নির্দ্বিধায় ক্যানসেল করছেন।

এই ধরনের অন্যায় ব্যবহার চলতে থাকলে জুনিয়র ডাক্তারদের মনোবল ভয়ঙ্করভাবে ভেঙে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন আর জি কর মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপিকা ডঃ অমৃতা সামন্ত।

অধ্যাপিকা অমৃতা সামন্ত, কমিউনিটি মেডিসিন, আর জি কর হাসপাতাল

তাঁর কথায় ক্ষোভ ও নিন্দার সুর স্পষ্ট, ‘দেশজুড়ে একটা সঙ্কটজনক পরিস্থিতি, যেখানে আমাদের পরিকাঠামো নেই, চিকিৎসক সংখ্যায় কম, মুখ্যমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন কিছু একটা করার, কিন্তু সেটাও তো সময় সাপেক্ষ! এই অবস্থায় যখন মানুষের পাশে মানুষেরই থাকার কথা তখন এই ধরণের ব্যবহারের নিন্দার কোনও ভাষা নেই। এ অন্যায়, চূড়ান্ত অসভ্যতা। নিজেদের জীবন বাজি রেখে যাঁরা চিকিৎসা করছেন তাঁদের বাড়ি ঢুকতে দেবেন না! অথচ ওনারা এটাই ভুলে যাচ্ছেন তাঁদের আজ কিছু হলে এই ডাক্তাররাই কিন্তু দেখবেন’

‘রবিবার পাঁচটায় বারান্দায় বারান্দায় যখন হাততালি পড়ছিল, শাঁখ বাজছিল, আমিও দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। মনে হল, এ যুদ্ধ সবার, কাল থেকে নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু হবে। কিন্তু পরদিনই ভুল ভাঙল- ওটা শুধুই হুজুগ ছিল না তো! নার্সিং দিদিদের ঘর ছাড়তে হুমকি দিচ্ছে। যে মেসে জুনিয়র ডাক্তাররা একসঙ্গে ভাড়া থাকে তাঁদের অন্য ঘর খুঁজতে বলা হল।

ইন্দ্রনীল সাহা, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ

মেডিকেল কলেজের এক ডাক্তারের ড্রাইভার বলে দিল সে আর গাড়ি চালাবে না, পাছে করোনা ইনফেকশন হয়! মনে রাখবেন, যাঁরা আপনার হয়ে যুদ্ধ করছেন, তাঁদের পাশে না দাঁড়ালে আপনার ‘হাততালি’ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। খুব শীঘ্রই দেশটা ‘ই-তালি’ হয়ে যাবে। বললেন, বিশিষ্ট স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এবং আই ভি এফ স্পেশালিস্ট ডঃ ইন্দ্রনীল সাহা।

গতকাল কলকাতায় এক বেসরকারি বিমানকর্মীর ট্যুইট ভাইরাল হল। দেখা গেল তিনি যখন উড়ছেন, তখন এই শহরেই তাঁর মাকে একঘরে করার চেষ্টা চলছে। মুদির দোকান, সব্জির দোকান তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ, তাঁর বিমানসেবিকা মেয়ে করোনায় আক্রান্ত। অথচ মেয়ে তখন জরুরি পরিষেবায় ব্যস্ত। ওদিকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার কারণে তাঁদের পরিবারে ঠাঁই হচ্ছে না বলে অমিত শাহের কাছে চিঠি লিখলেন এইমসের ডাক্তাররা। গোটা ঘটনায় তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করলেন। ভয়ে সকলেই সন্ত্রস্ত। কিন্তু সেই ভয় কী মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক চেহারাটুকুও পাল্টে দেবে?

ওদিকে করোনা ভাইরাস অতিমারী কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ ত্বরান্বিত হচ্ছে তার গতি। মোকাবিলায় প্রয়োজন আরও বেশি আগ্রাসী পদক্ষেপ। এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (হু)-এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস অ্যাধানোম ঘেব্রেয়েসাস। সেসব দিকে বোধহয় আমাদের খেয়াল নেই। দুদিন আগেই রবিবারের বিকেলে জরুরি পরিষেবায় নিযুক্তদের মনোবল বাড়াতে, উৎসাহ দিতে তালি দিয়েছিলাম যেই আমরা, অদ্ভুতভাবে তাঁরাই আজ ওদের হাত চেপে ধরছি! পরোক্ষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ বাড়াচ্ছি সেইসব যোদ্ধাদের ওপর যাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পথে নেমেছেন আমাদেরই বাঁচাতে! মানবিকতার, মনুষ্যত্বের মুখোশ খুলে গিয়ে তবে কী দাঁত, নখ বেরিয়ে পড়ছে দুদিনেই? ভয় মানুষকে কী এতটাই সংকুচিত, এতটাই স্বার্থপর করে দিতে পারে?

এবার কিন্তু সত্যিই ভয় করছে! করোনা নয়, আরও ভয়ঙ্কর কোনও ভাইরাসের ভয়। আগামী দিনগুলোয় দ্রুত গতিতে আরও কত কত মনুষ্যত্বের বলি চড়াবে সেই ভাইরাস? ভেবেই শিউরে উঠছি।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img