(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)
হীরক কর : অ্যালকেমি একটি রহস্যময় বিদ্যা। কোন একটা পদার্থকে ভেঙে তাৎক্ষণিকভাবে অন্য এক পদার্থের রূপান্তর করাই হচ্ছে এই বিদ্যার মূল বৈশিষ্ট্য। তবে এটা জাদু নয়, এ এক ধরনের বিজ্ঞান। এই কাজে যাঁরা দক্ষ এবং এই নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের ডাকা হয় অ্যালকেমিস্ট বলে।
অ্যালকেমির সাহায্যে শূন্য থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। এর প্রধান কারণ, কোন কিছু তৈরি করতে অবশ্যই এর সমপরিমাণ ও সম বৈশিষ্ট্যময় পদার্থ বিসর্জন দিতে হবে। আর যাঁরা এই নিয়মের অন্যথা করবেন, তাঁদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে পরিষ্কার বলা আছে, অ্যালকেমি হচ্ছে এমন একটি বিদ্যা, যা লোহা বা পাথরকে সোনা বানিয়ে দিতে পারে। তাই মধ্যযুগে অনেকেই অ্যালকেমিস্ট হয়েছেন, বিশেষ করে যারা প্রাচীন গ্রিস এবং মিশরে এই রহস্যময় বিজ্ঞান চর্চা করতেন। আর অ্যালকেমিস্ট শব্দটিকে সামনে রেখে আমজনতার কষ্টার্জিত টাকা লুটেছেন সদ্য গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কে ডি সিং। যেমন মা সারদার ঘোমটার আড়ালে পঞ্জি স্কিম চালাতেন সুদীপ্ত সেন ।
আবার ‘দি আলকেমিস্ট’ হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহো রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। এটি মূলত পর্তুগিজ ভাষায় রচিত হয় এবং অক্টোবর ২০০৯ পর্যন্ত অন্তত ৬৭টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। দি আলকেমিস্ট একটি রূপকধর্মী উপন্যাস, যেখানে নায়ক একজন তরুণ আন্দালুসিয়ান মেষপালক।
বুধবার দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হয় আলকেমিস্টের কর্ণধার প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কে ডি সিংকে। তাঁর সংস্থা অ্যালকেমিস্ট বাজারে আমানতকারীদের থেকে কয়েকশো কোটি টাকা তুলেছিল বলে অভিযোগ। ২৩৯ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
কেডির ওপর নজরদারি চলছিল বহুদিন ধরেই। দুই বছর আগে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগে কে ডি সিংয়ের ২৩৮ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি৷ সেই সময়েই দেশের বিভিন্ন জায়গায় কে ডি সিংয়ের একাধিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল৷ একে একে কুফরির একটি রিসর্ট, চণ্ডীগড়ে শো-রুম, পঞ্চকুলা ও হরিয়ানায় একাধিক সম্পত্তি ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করা হয়৷
হিমাচলপ্রদেশে তৃণমূলের প্রচারে গিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিলেন দলের দুই নেতা। চণ্ডীগড়ে বিমান থেকে নামার পর তাঁদের শিমলা নিয়ে গিয়েছিল এক পেল্লায় ‘সেডান’। থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বিলাসবহুল হোটেলে। প্রচারে যেতেন হাই এন্ড এসইউভি-তে চেপে। আতিথেয়তায় গদগদ দুই নেতা কলকাতায় দলের সতীর্থদের ফোন করে তাঁদের উচ্ছ্বাসের কথা জানাতেন রোজ। তৃণমূলের দুই নেতার নির্বাচনী প্রচারের সেই সফরে পুরো ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কুঁয়ার দীপ বা কুমারদীপ সিং বা ‘কে ডি সিং’।
চকচকে পোশাক, পায়ে দামি মোকাসিন, রিমলেস চশমা, ম্যানিকিওর করা হাতের নখ, নিজস্ব চাটার্ড বিমান—এই সব বৈশিষ্ট্য হল কে ডি সিংয়ের। শুধু কাশীর অলিগলি নয়। তাঁর বিচরণ ভারতীয় রাজনীতির সৌরজগতে। এমনকি, তাঁর টুব্রো ফিনান্স গ্রুপের কারখানার উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের সাংসদ হলেও কেডি-র কোনও কারখানা বা প্রকল্পের উদ্বোধনে দেখা যায়নি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
ইডি-র খাতার প্রায় ২০০ কোটি টাকা প্রতারণায় অভিযুক্ত কেডি।সিং। রাজ্যসভার নথি অনুযায়ী, ১৯৬১ সালের ২১ অগস্ট পাঞ্জাবের ফতেগড় সাহিবে কেডি-র জন্ম। পাতিয়ালার পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের স্নাতক। এছাড়া ব্রিটেনের অ্যাংগলিয়া রাস্কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডক্টরেট ডিগ্রিও করেছেন। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা চণ্ডীগড়ের অভিজাত এলাকা সেক্টর ৯-বি। স্ত্রী-র নাম হরপ্রীত কৌর। দুই পুত্রসন্তানের জনক তিনি।
২০১০ সালের জুলাই মাসে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার টিকিটে প্রথম বার রাজ্যসভার সাংসদ হন কে ডি সিং। এরপর ২০১৪ সালে ফের রাজ্যসভার সদস্য হন তিনি। কেডি-কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেসময় তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মুকুল রায়। তাই অবিলম্বে
মুকুল রায়কে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।
খবর অনুযায়ী, ‘তহেলকা’ নামে একটি সংবাদমাধ্যমের অন্যতম মালিক ছিলেন কেডি।
তাঁর নির্দেশেই নারদ স্টিং অপারেশন হয়েছিল বলে প্রকাশ্যেই দাবি করেছিলেন সংস্থার প্রাক্তন সিইও ম্যাথু স্যামুয়েল। ম্যাথুর দাবি, এই স্টিং অপারেশনের জন্য তাঁকে ৮০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন কেডি।
রাজ্যসভায় হাজির থাকার জন্য বিভিন্ন সময়ে তৃণমূলের পক্ষ থেকে ‘হুইপ’ জারি হলেও, কেডি সভায় গরহাজির থাকতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে গেলেও, তাঁর আশেপাশে কখনও দেখা যায়নি কে ডি সিং-কে। তবে কলকাতায় এক প্রভাবশালীর বিয়েতে কে ডি-কে কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। শোনা যায়, ওই প্রভাবশালীর স্ত্রী নাকি কে ডি-সিংয়ের আত্মীয়া।
পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় প্রধান অভিযুক্তের তালিকায় কে ডি সিংয়ের নাম ছিল তিন নম্বরে। তাঁর বিরুদ্ধে সাইপ্রাস-সহ কয়েকটি দেশে টাকা পাচারের অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রাক্তন এই তৃণমূল সাংসদের বাড়ি ও অফিসে হানা দিয়ে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল ইডি। একাধিক শো-রুম, রিসর্ট, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯৮৮ সালে টুব্রো ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি খুলেছিলেন কেডি। ২০০৪ সালে ওই কোম্পানিরই নাম বদলে রাখেন অ্যালকেমিস্ট গ্রুপ। স্বাস্থ্য, আবাসন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চা শিল্প-সহ নানা ক্ষেত্রে দেশেবিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি রয়েছে কেডি-র। ‘কেএফসি’-র পাল্টা হিসেবে তিনি বাজারে এনেছিলেন ‘রিপাবলিক চিকেন’।
কেডি-র সংস্থা অ্যালকেমিস্ট ইনফ্রা রিয়েলিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সেবি-র নিয়ম ভেঙে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৩ সালে আর্থিক তছরুপ এবং অন্যান্য অনিয়ম নিয়ে সেবি, সিবিআই এবং ইডি-র কাছে অভিযোগ দায়ের হয়। নিয়ম ভেঙে বিদেশে ১০ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে ২০১৮ সালের অগাস্টে ‘অ্যালকেমিস্ট’-এর যাবতীয় স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচার উপর স্থগিতাদেশ জারি করে কলকাতা হাইকোর্ট।