তপন দাস, বিশিষ্ট চিত্র সাংবাদিক
সত্তরের দশকে সকাল বিকেলে রোজই শুনতাম বোমার আওয়াজ। গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার মিল্ক কলোনি এলাকায় ফ্রেজার হস্টেলের একদল ছেলে তেড়ে ধেয়ে আসতো আমার পাড়ার গেটের মুখে। শুধুই বোমার শব্দ। চারদিকে বারুদের গন্ধ।
একটা শীর্ণকায় চার ফুট দশ ইঞ্চির ছেলে। “আমার দেখা গ্যাংস্টার অনু” মোকাবিলা করত হস্টেলের জনা পঁচিশ ছেলের সঙ্গে। যারা হতে চলেছিল ভেটেনারির ডাক্তার, তাদের রোজ ভাগিয়ে দিত একা অনুই। তারা এবং ওই এলাকার পার্টির অন্য লোকেরা এক হলেও, গ্যাংস্টার অনুর তারা কোনও ক্ষতিই করতে পারতো না।
অনু আমার পাড়ার বাসিন্দা। পাড়ার মনোহর অ্যাকাডেমির নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। পকেটে থাকতো বোমা। আর কোমরের বেল্টে পিস্তল। সব সময় অন্য দলের টার্গেট ছিলো ঐ একজনই “অনু”। ও ছিল এলাকার পলিটিক্যাল ত্রাস।
কিন্তু ওকে কেউ সমাজবিরোধী বা দুষ্কৃতী বলতে পারবে না। কারোর থেকে কোনও দিন টাকাপয়সা বা অন্য কোনো ডিমান্ড ছিল না। কোনওদিন করেওনি।
আমরা ওকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথা থেকে টাকা পয়সা পাস। অনু বলেছিল, “আমার বিরোধীরা যেভাবে লোকের থেকে চাঁদা তোলে। দাদা, আমাদের সমর্থক আছে, তারাই জোগায়। হপ্তাহে সিনিয়রদের কাছে দু’দিন ক্লাস করতে হয়।”
পাড়ায় বড় হয়েছে বলে ওর অনেক সমর্থক ছিল। সবার সাথে ও আমাদের সাথে ওর ব্যবহার ছিল দাদাভাইয়ের মত। আমরা যারা আড্ডা মারতাম, তারা কোনও দলের সমর্থক ছিলাম না।
অনুদের সেই মাওয়ের চিনই এখন গোটা দুনিয়ায় এক নম্বর দেশ হবার লড়াই চালাচ্ছে। তখন অনুর মুখেই শুনতাম, ইতিহাসের ধুলোয় মিশে যাবে দারিদ্র, বঞ্চনার, দাসত্বের ইতিহাস।
কোনও দল বা ইজম, অবশ্য আমার মাথায় কেউ কিছুই ইনজেক্ট করতে পারেনি। জীবনের শেষ বেলায় এসে মনে হয সব ইলিউশন।
যে করে হোক গ্যাংস্টারকে সরাতে পারলেই, অঞ্চলটা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হবে। এই আশা করেছিল, অন্য দলের নেতা ও তাদের দলবল। তাই একা অনু আর অন্য দলের লোকজন নেমে পড়তো যুদ্ধ ক্ষেত্রে। যেন হয়ে উঠতো রূপালি পর্দার শুট আউট এনকাউন্টারের তখনকার চেনা লোকেশন! গুলিবোমার লড়াইয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো মিল্ক কলোনি।
আমাদের আগের পাড়ায় বেরোনোর মুখে বড় রাস্তায় আড্ডা বসতো। তাদের সমাজবিরোধী বলা যাবে না। সেই সময়ে বলা হত, “রংবাজ” রুস্তম। মিল্ক কলোনিতে এসেই সেটা টের পেয়েছিলাম। দত্তবাগান মোড়ে। আমাদের বাসে উঠা নামা ছিল ওখানেই। আমাদের মিল্ক কলোনীতে ঢোকার ঐ একমাত্র রাস্তা।
সেই তেষট্টি সালে দেখতাম, দু একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো। একজন একটা লিমুজিন গাড়ি নিয়ে আসতেন। তিনি মাছের বড় আড়তদার। তাঁর সাথে থাকতেন নিমাইদা বলে একজন। তিনি ছিলেন ঐ দলের লিডার। তাদের ব্যাপার-স্যাপার সব আলাদা ছিল। তাঁরা কোন পার্টির সমর্থক ছিলেন বলে জানি না। তবে অবশ্যই লাল ছিলেন না।
সত্তর দশকের পর তাদের আর দেখা যায়নি। ভেঙে গেল সেই দল। ছেড়ে ছুড়ে কোথায় চলে গেল তারা। আমার দেখা সেই গ্যাংস্টার অনুই সবার মৌরসিপাট্টা বন্ধ করে দিয়েছিল। সবাই তাকে ভয় পেতো। অবশ্যই যারা পার্টি করতো।
আমাদের আড্ডায় মাঝে মাঝে আসতো। আমাদের সবাইকে দাদা বলতো। কেন জানি না ভীষণ সম্মান করতো আমাদের। ছোট থেকে দেখেছি বলে হয়তো। অনেকবার এমন হয়েছে অনুর দলের ছেলেরা মানে যারা নকশাল করতো, তারা আমাদের কাছে এসে বলতো, “আপনারা যে আড্ডা মারেন, এই মধ্য পন্থা আর চলতে পারে না। হয় আমাদের দলে আসুন নয়তো অন্য যে দলটা আমাদের শত্রু তাদের দলে যান।”
পরে অনুর সাথে আমাদের দেখা হতে ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। তার পর ওই দলের কেউ আর আমাদের বিরক্ত করেনি। সেই সময়ে আমার পুরোনো পাড়ায় বাগবাজারে গেছি। ছেলেবেলা থেকে যাদের সাথে দিনের পর দিন একসঙ্গে আড্ডা মেরেছি, তাদের সঙ্গে অনেক অনেক দিন পর দেখা। পরিস্থিতি যে এতটা পাল্টে গেছে, তা ভাবতেই পারিনি। আনুর ব্যাপারে আমাকে তাদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল। বাগবাজারের সেই পুরোনো বন্ধুরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের কাছে খবর আছে, তুই অনুর এক নম্বর লোক। অনুকে তোরা স্পনসর করিস।”
ছেলেবেলার সেই পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সেদিন বেশ কথাকাটি হয়েছিল, যা আমি মোটেই আশা করিনি। বুঝেছিলাম, এই সময়ে পার্টি ছাড়া আর বোধ হয় বাঁচতে পারবো না। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের পরিবর্তন দেখে ভেবেছিলাম, পার্টি পলিটিক্স সম্পর্কের বাঁধনে ইতি টেনে দিলো। একথা সেই দিন বুঝেছিলাম হাড়ে হাড়ে। সেদিনের সেসব ঘটনা আজও মনকে ভীষণ পীড়া দেয়।
একসাথে বেড়ে ওঠা, গরমের ছুটিতে বাড়িতে না বলে বাগবাজারের শ্রীমার ঘাটে একসাথে সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে রবারের বলে অনেক জায়গায় টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া, দশ আনার লাইনে দল বেঁধে সিনেমা দেখা। সব শেষ করে দিয়েছিল শুধু এই পলিটিক্স। সেই থেকেই সম্পর্ক গুলো সব ভেঙ্গে গেল। বাগবাজারের বন্ধুদের হারালাম। সেটা আমার কাছে ভারী কষ্টের, খুবই দাগা খেয়েছিলাম।
এই ঘটনার বেশ কয়েক দিন পর বালা নামে ফ্রেজার হস্টেলের ছক লিডার কাম সিনিয়র ছাত্র ও কয়েকজন, আমাকে এবং আমার কয়েকজন বন্ধুকে (যাদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম), আলোচনা আছে বলে ওদের ঐ এলাকার অন্য একটা হস্টেলে ডেকে নিয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে তারা বহুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চালায়।
তাদের একটাই জিজ্ঞাসা, অনু কখন কোথায় থাকে, কখন কবে বাড়ি ফেরে, এ ধরনের নানা প্রশ্ন। পরে এই বালা উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে এমপি হন। পরে আমার সাথে দেখা হয়েছিল বহু বছর পর। তখন বামফ্রন্ট সরকারের জমানা। তিনি চিনতে পারলেন না। আর সেই দিনের কথা বলাতে বললেন, মনে নেই। আমাকে অবাক করেছিল বালাদার ব্যবহার। এরাই তো জনগণের সেবক। মিথ্যাচারের চূড়ামণি। কত কি দেখলাম!
সেই সময়ে সেন্ট্রাল ডেয়ারির দুধের গাড়িতে আসছিল কলেজ স্ট্রিট এলাকার বিখ্যাত “ফাটাকেষ্ট” (তখনকার নাম করা মধ্য কলকাতার বিখ্যাত গ্যাংস্টার)। শুনেছিলাম তার গায়ে নাকি ছত্রিশটা ভোজালির কোপ ছিল। অনুর দল দুধের ভ্যান লক্ষ করে মারলো কয়েকটা হাত বোমা।
ঐ অঞ্চলেরখুবই কাছে ই ছিলাম।
আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি, দুধের গাড়িটা উল্টে গেছে। গাড়ির চালক বাহাদুর স্পটেই মারা গেল। সে ঐ অঞ্চলের খুবই পরিচিত ড্রাইভার। পরে জানতে পারলাম টার্গেট ছিল ফাটাকেষ্ট। কোনও রকমে বেঁচে পালিয়ে গেছে।
তারপর পাড়ায় পুলিশের ছয় লাপ। আগেই বাড়িতে ঢুকে গেলাম। পরের দিন আমার বাড়ির সামনে সকালে পুলিশর বড় ভ্যান সাথে জিপ। আমি বাইরে বেরোতেই এক অফিসার বললেন, “এটা তারকবাবুর বাড়ি? উনি আছেন? একটু ডাকুন।”
বাবা এলেন, বললেন, কী ব্যাপার? কিছু মনে করবেন না তারকবাবু আপনার বাড়ির পিছনের দিকটা একবার যাব, অনুমতি দিন। বাবা বললেন, আসুন। পিছনে ঢুকে তন্নতন্ন করে চষে ফেললেন পুরো রেল লাইন অঞ্চলের সবটা। ঘন্টা খানেক তল্লাশি চালানোর পর কিছু না পেয়ে বাবাকে বললেন, “অনুর সব বোমা, পিস্তল, মালমশলা এখানেই থাকে। আমাদের ডেফিনিট খবর ছিল।”
বাবা বললেন, “পেলেন না তো কিছুই। একরত্তি একটা ছেলেকে ধরতেই লালবাজার থেকে প্রায়ই আসছেন, বারবার আসতে হচ্ছে।” পুলিশ বাহিনী চলে গেল। আধ ঘণ্টার কিছু পরেই পরেই অনু এসে হাজির। কী ব্যাপার রে? অনু, দাদা গতকাল রাতেই এখান থেকেই সব সরিয়ে নিয়ে গেছি! বললাম, তোর দলের কেউ খবর দিয়েছে পুলিশকে। বলল, “না না দাদা, আমি জানি, কে দিয়েছে খবরটা। ঠিক আছে, দাদা চলি।”
সেই যে অনু চলে গেল। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর কেটে গেছে। রাজত্ব পাল্টে গেলো। তার পরেও আর তার দেখা বা খোঁজ পাইনি। বেশ কয়েক বছর পর একদিন অফিস যাবো, বাসে উঠতে যাচ্ছি। হঠাৎ ডাক পেয়ে ঘুরে দেখি, অনু। হাত পা বাঁধা। আমি ভাবতেই পারিনি। অনেক রোগা, চোখ কোটরে। একজন বললো, বলুন, তপনদা কী করবো এবার অনুকে। কী আর করবে! ওর চেহারা দেখেই তো মনে হচ্ছে মরে গেছে। একে মারবে কোথায়?
আমাকে যে ডাকলো, সে তখনকার “শের”। ভীষণ চিনতো আমাকে। দাদা ডাকতো অনুর মতো। ওরা আমার কথায় সত্যিই ছেড়ে দিল। মুখ থেকে চুল্লুর গন্ধ। বললাম, “কী করিস? এতদিন কোথায় ছিলি?” কোনও উত্তর নেই। বললো, খাবো আর কিছু টাকা দেবেন? মিষ্টির দোকান বলে দিলাম, যা খেতে চায় খাইয়ে দাও। পকেটে যা ছিল দিয়ে অফিসে এলাম।
তবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। এরপর অনেক দিন দেখিনি আমাদের তল্লাটে। এর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন দুধের ফ্যাক্টরির (সেন্ট্রাল ডেয়ারি) সামনে দেখি বেশ ভিড়। একজন পড়ে আছে, তাকে ঘিরে সবাই।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি, জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে চোখটা খুলেই পড়ে আছে গ্যাংস্টার অনু। সবাই বলছে, ক’দিন ধরে এখানেই দেখছি, চুল্লু খেয়ে পড়ে থাকে। আজ দেখছি মারা গেছে।
ভেতরটা দুমড়ে মুছড়ে গেল। ছেড়ে এগিয়ে এলাম। গ্যাংস্টারের এই হাল হবে ভাবতে পারিনি। অনুতো একটা স্বপ্ন নিয়েই দলে নামটা লিখিয়েছিল। কী বাতাস আর স্বপ্ন নিয়ে চলে গেল সেই জানে। আমার কাছে শুধুই কষ্টের নয় বেদনারও। এই ভাবে কত অনুর মত গ্যাংস্টারের এই হাল হয়ে ছিল সত্তরের দশকে। এখন ভাবলে শিউরে উঠি।